বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ চিত্রা হরিণ। কিন্তু চোরাশিকারিদের হাতে দিনের পর দিন বনের হরিণ নিধনের বিষয়টি বলতে গেলে ‘ওপেন সিক্রেট’।
খোদ বনবিভাগ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, চলতি বছরের শুরু থেকে এই পর্যন্ত অন্তত ৫০ জন চোরাশিকারিকে হরিণের মাংস এবং চামড়াসহ আটক করা হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছে, সুন্দরবন সংলগ্ন উপজেলা এবং আশপাশের এলাকায় দাম কম হওয়ায় এই বন্যপ্রাণীর মাংসের চাহিদা বেড়েছে। এই সুযোগে গত কয়েক মাস ধরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোরাশিকারিরা। বিভিন্ন উৎসব-পার্বনে এসব চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়ে যায়।
তাদের অভিযোগ, সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় কয়েকটি চক্র অনেক আগে থেকেই হরিণ শিকারের সঙ্গে জড়িত। বনবিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে একশ্রেণির ‘গডফাদার মহাজন’-এর কাছ থেকে অগ্রিম ‘দাদন’ নিয়ে জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে বনে ঢুকে চোরাশিকারিরা। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে ‘এজেন্ট ব্যবসায়ীদের’। এই এজেন্টদের মাধ্যমে কখনও অগ্রিম, আবার কখনও মাংস এনেও বিক্রি করা হয়ে থাকে। এই চক্রের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানেও পৌঁছে যায় হরিণের মাংস।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক স্থানীয় ব্যক্তি জানান, ক্রেতারা অনেক সময় প্রতারণা ভেবে হরিণের মাংস কিনতে চান না। তাই চোরাশিকারিরা জীবন্ত হরিণ লোকালয়ে এনে জবাই করে থাকেন।
সুন্দরবন অ্যাকাডেমির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেন, “বন্যপ্রাণী শিকার নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ চিত্রা হরিণ শিকার করছে কয়েকটি চক্র। যে পরিমাণ হরিণের মাংস এবং চামড়া জব্দ হয়, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি হরিণ শিকার হয়।
মাঝে-মধ্যে দুএকটি অভিযানে হরিণের মাংস, চামড়া, মাথা জব্দ হলেও মূল চোরাশিকারি এবং পাচারকারীরা থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাংস বহনকারীরাই ধরা পড়ে। তারা দুর্বল আইনের কারণে কয়েকদিন পর জেল থেকে ফিরে একই কাজে লিপ্ত হন বলে দাবি আনোয়ারুল কাদিরের।
তিনি আরও বলেন, “বনে বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণ। সুন্দরবনের ইকো সিস্টেমের ভারসাম্য রাখতে সব প্রাণীরই প্রয়োজন। কোনো একটি না থাকলে সিস্টেম নষ্ট হয়ে যায়।”
অভিযানে আটক হরিণ শিকারিদের দেওয়া তথ্য থেকে দেখা গেছে, বনের পাশে যাদের বাড়ি, তারাই বেশি হরিণ শিকারের সঙ্গে যুক্ত। বিশেষ করে, খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা, সাতক্ষীরার শ্যামনগর এবং বাগেরহাটের মোংলা ও শরণখোলা উপজেলার মানুষ বেশি হরিণ শিকার করেন।
ধনাঢ্যব্যক্তিরা হরিণের মাংস দিয়ে উৎসব করেন। কেউ কেউ স্বজনদের হরিণের মাংস উপহার দেন। আবার বড় ধরনের স্বার্থ সিদ্ধির জন্যও কর্তাব্যক্তিদের খুশি করতে গোপনে হরিণের মাংস সরবরাহ করা হয়। হরিণের চামড়া-শিং সৌখিন ব্যক্তিরা সংগ্রহ করে ড্রইং রুম সাজান।
খুলনার কয়রা উপজেলা প্রশাসন থেকে জানা যায়, সুন্দরবন-সংলগ্ন উপজেলায় হরিণ শিকারিদের দৌরাত্ম্য সব চেয়ে বেশি। গত তিন মাসে এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪৭৯ কেজি হরিণের মাংস, একটি গলাকাটা হরিণ, পাঁচটি চামড়া ও মাথা জব্দ করে প্রশাসন। এ সময়ে মামলা হয়েছে ১০টি, গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬ জন।
অতিসম্প্রতি তিন মণ হরিণের মাংসসহ এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বাসিন্দা হারুন গাজী বলেন, সুন্দরবন প্রভাবিত কয়রার গ্রামগুলোতে বেশিরভাগই শ্রমজীবী মানুষের বসবাস। এসব গ্রামের প্রতিটি পরিবারের কেউ না কেউ সুন্দরবনকেন্দ্রিক কাজের সাথেই সম্পৃক্ত। এই উপজেলার ৩০টির বেশি চোরাশিকারি চক্র নির্বিচারে সুন্দরবনের হরিণ নিধন করছে। এর মধ্যে দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের আংটিহারা এবং জোড়শিং এলাকায় হরিণশিকারি চক্রের দৌরাত্ম্য বেশি। আর হরিণ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বজবজা এবং খাসিটানা বন টহল ফাঁড়ি এলাকা।
হারুন বলেন, সুন্দরবনে আগে বন্দুক ব্যবহার করা শিকারি বেশি ছিল। এখন নাইলনের এক ধরনের ফাঁদ ব্যবহার করে শিকারিরা। হরিণের নিয়মিত যাতায়াতের পথে এগুলো পাতা হয়।
তিনি আরও বলেন, অবৈধ জেনেও কম দাম পেয়ে হরিণের মাংস কেনেন মানুষ। সুন্দরবনসংলগ্ন এলাকায় প্রতি কেজি হরিণের মাংস ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় পাওয়া যায়। তবে জেলা শহরে প্রতি কেজি হরিণের মাংসের দাম ১০০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা পর্যন্ত। আর জীবিত এক একটি হরিণের দাম চাওয়া হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।
কয়রার ইউএনও মো. মমিনুর রহমান বলেন, সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রায় সুন্দরবনকেন্দ্রিক অপরাধপ্রবণতার চিত্র তাদের উদ্বিগ্ন করেছে।
মমিনুর বলেন, “বিশেষত হরিণশিকারিদের দৌরাত্ম্য রুখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বন বিভাগকে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।”
সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেনের ভাষ্য,এতো অল্প জনবল দিয়ে এত বড় বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খেতে হয় বনবিভাগের। তারপরও হরিণ শিকার আগের তুলনায় অনেকাংশে কমেছে। র্যাব, কোস্টগার্ড, বিজিবি এবং বনবিভাগের নিয়মিত টহলের কারণে এখন বনে হরিণ শিকারের সুযোগ কম।