এম. জাকির হোসেন, গবেষক
রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া নিয়ে সচেতনতার পরিবর্তে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে! প্রচার এমনভাবে হচ্ছে যে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ এবং কামড় দিলে নির্ঘাত মৃত্যু। বিদেশী একটি নাম ছড়িয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে।এর দেশীয় নাম চন্দ্রবোড়া। এটি কেবল ভারতীয় সাপ নয়, আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে বা ভৌগলিক অঞ্চলে এর বাস শত শত বছর ধরে বিশেষত রাজশাহী অঞ্চলে।এজন্য একে বরেন্দ্র সাপ ও বলা হতো।
যারা ফেসবুক মারফরত এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত জেনে আতঙ্কিত হচ্ছেন তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, বিষাক্ততায় এটি ১ম বা ২য় দূরে থাক বিশ্বের সবচেয়ে বিষাক্ত ১০ টি সাপের তালিকায় ও নেই। কিন্ত এর অর্থ এই না এটি বিষাক্ত নয় বা এর আক্রমনে মৃত্যুঝুঁকি নেই। আগে এটি রাজশাহী অঞ্চলে দেখতে পাওয়া যেতো কিন্ত এখন এটি দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে বিধায় এটি অবশ্যই উদ্বেগের! এর কামড়ে মৃত্যুঝুঁকি আছে তাই এটি নিয়ন্ত্রনে কার্যকর ব্যবস্থা ও নিতে হবে।
রাসেল ভাইপারের বিস্তার রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি অবশ্যই জরুরি কিন্ত সচেতনতা সৃষ্টির পরিবর্তে আতঙ্ক সৃষ্টি করে মানুষকে আক্রান্ত হবার আগেই মেরে ফেলবেন না দয়া করে। আপনাদের ভুল প্রচারের কারনে অনেক অঞ্চলে এর উপস্থিতি লক্ষ্য না করার পরও সে অঞ্চলের মানুষের রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে গিয়েছে, দিন রাত আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে!
গোখরা কিংবা কেউটে সাপের সাথে আমরা সকলে পরিচিত, তাকে নিয়ে কি আমরা এত আতঙ্কিত হচ্ছি? এদের কামড়ে কি মৃত্যুঝুকি নেই? আপনি জানেন কি বিষাক্ততায় রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া এর অবস্থান আমাদের দেশের গোখরা বা ক্রেইটে কিংবা কেউটে বা কোবরা এরও নিচে এবং এর কামড়ে সুস্থ হওয়া অহরহ মানুষ আছে। গোখরার কামড়ে যেখানে ৮ ঘন্টার মধ্যে এন্টিভেনম প্রয়োগ না করলে মৃত্যু হতে পারে সেখানে রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়ার ক্ষেত্রে সেটি ৭২ ঘন্টা। কিন্ত এর মানে এই না রাসেল ভাইপারে আক্রান্ত হলে ৭২ ঘন্টা চিকিৎসা নেবার সময় পাবেন, মৃত্যু হবেনা। এ সাপের বিষের বিশেষত্ব হলো আপনার মৃত্যু দ্রুত না ঘটালেও এর আক্রমনে আপনার হার্ট ফেইলিউর, কিডনি অকার্যকর, ফুসফুসে জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, রক্ত জমাট বেধে ফেলতে পারে! তাই প্রধান কাজ হচ্ছে, লোকজনকে আতঙ্কিত না করে প্রয়োজনীয় সচেতন করা যাতে এ সাপে আক্রান্ত হলে কবিরাজ, ওঝা বা ঝাড়ফুঁক এর শরনাপন্ন না হয়ে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং দ্রুত এন্টিভেনম প্রয়োগ করলে উপরে যেসব শারীরিক জটিলতার কথা বলা হয়েছে তা বহুলাংশে কমানো সম্ভব।সাধারনত হাসপাতালে নিয়ে এন্টিভেনম দেওয়া গেলে রাসেল’স ভাইপারের কামড়ে সুস্থতার হার ৭০% এর মতো প্রায়। যদি সঠিক সময়ে দ্রুত সঠিক চিকিৎসা নেয় তবেঁ সুস্থতার হার ৯০% এর চেয়ে বেশি হতে পারে।
রাসেলভাইপার বা চন্দ্রবোড়া নিয়ে আরেকটা ভুল প্রচার হলো এই সাপ মানুষ দেখলেই তেড়ে এসে আক্রমন করে। বাস্তবে রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাধারণত অলস প্রকৃতির। এরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আক্রমন করেনা। এ সাপ “মানুষকে তেড়ে এসে কামড়ায়” এ কথা গুজব মাত্র। এরা মূলত ambush predator, তাই এক জায়গায় চুপ করে পড়ে থাকে। মানুষ বা বড় কোন প্রাণী সামনে এলে S আকৃতির কুণ্ডলী পাকিয়ে খুব জোরে জোরে হিস্ হিস্ শব্দ করে। তারপরও তাকে বিরক্ত করা হলে তবেই অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছোবল মারতে পারে। ছোবল দেওয়ার সময় শরীরের সামনের দিকটা ছুঁড়ে দেয় বলে ঐ “তেড়ে এসে কামড়ায়” জাতীয় ভুল ধারণার জন্ম।
রাসেল ভাইপার যে কেবল ক্ষতি করে থাকে তা নয়। এর বিষ কিছুক্ষেত্রে আশির্বাদ ও। চন্দ্রবোড়ার বিষ রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে, একারণে হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে রক্ত জমাট বাঁধা সংক্রান্ত পরীক্ষায় এর ব্যবহার রয়েছে। রক্ত জমাট বাঁধা, গর্ভধারণ বিষয়ক জটিলতা যেমন- গর্ভপাতকারী এক রোগ নির্ধারণের পরীক্ষায় (ডাইলিউট রাসেল’স ভাইপার ভেনম টাইম) লুপাস অ্যান্টিকোয়াগুল্যান্টের উপস্থিতি নির্ণয়ে চন্দ্রবোড়ার বিষ ব্যবহৃত হয়।
পরিশেষে উল্লেখ্য যে, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিবমবঙ্গের প্রায় প্রত্যেকটা জেলায় এই বিষাক্ত চন্দ্রবোড়া রয়েছে। সেখানে অনেকে আক্রান্ত হচ্ছে, দ্রুত চিকিৎসা করালে সুস্থ্য ও হয়ে উঠছে। যে কয়েকজনের মৃত্যু ঘটছে তার অন্যতম কারন হলো আক্রান্ত হবার পর দ্রুত হাসপাতালে না নেওয়া এবং এন্টিভেনম প্রয়োগ না করা। চন্দ্রবোড়া আছে জন্য কি তারা কি রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে? আতঙ্কে ঘুম খাওয়া ত্যাগ করেছে?
তাই আতঙ্কিত না হয়ে আমরা সচেতন হই যাতে এটি দেশের সকল অঞ্চলে ছড়িয়ে না পড়ে আর আক্রান্ত হলে ওঝা-কবিরাজ এর কাছে নিয়ে ঝাড় ফুক দিয়ে জীবন না হারাই। আরেকটা জোর দাবী তোলা উচিৎ তা হলো কেবল জেলার সদর হাসপাতালে নয় বরং উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতাল এবং কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতেও পর্যাপ্ত এন্টিভেনম সংরক্ষন করা হোক। এন্টিভেনমের অভাবে যেনো কোনো রোগী না মারা যায়।জরুরি ভিক্তিতে দেশে এন্টিভেনম উৎপাদন করা হোক, প্রয়োজনে ভারত বা অন্য দেশ হতে জরুরি সেবাপন্য হিসাবে এন্টিভেনম আমদানি করে দেশের সকল পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে সরবরাহ করা হোক।