স্বার্থ ও ক্ষমতার লাগামহীন লিপ্সা, প্রতিহিংসা এবং জিঘাংসা ‘আশরাফুল মখলুকাত’ মানুষকে কখনো পশুর চেয়েও বেশি পাশবিক করে তোলে, তাই বিশ্বের ইতিহাস বারবার রঞ্জিত হয়েছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের রক্তে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সমগ্র পৃথিবীর মেহনতি এবং শোষিত মানুষকে করেছিল বাকরুদ্ধ। বিশ্বের নিপীড়িত এবং নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতীক হিসেবে বঙ্গবন্ধু নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, নিজ মেধা ও যোগ্যতায়- বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন তার বক্তব্যের মর্মার্থ। তিনি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন, শোষিত মানুষের জন্য আজীবন সংগ্রাম করে যাবেন। আমৃত্যু অসহায় মানুষের আশা ও স্বপ্নের প্রতিধ্বনি হয়ে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল ছিলেন তিনি। অথচ সেই ক্ষণজন্মা মানুষটিকেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে তারই প্রতিষ্ঠিত বাংলায়। নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতম ছিল পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডটি। তাই বেদনায় বাকরুদ্ধ বাঙালির শোকের মাস ১৫ আগস্ট।
পুঁজিবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পুঁজিকারী কায়েমী গোষ্ঠী তার অগ্রযাত্রা ও সাফল্যে ভীত হয়ে উঠেছিল, আর তাদেরই নীলনকশার বলি হতে হয় বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রায় সবাইকে। বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মূল উদ্দেশ্য কেবল ব্যক্তি মুজিবকে হত্যা নয়, বরং তার আদর্শকে হত্যার চেষ্টাও। স্বাধীনতা শব্দটি বঙ্গবন্ধুর মতো করে কেউ বলতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতেন। তিনি বাঙালি জাতিকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন একটি ঐক্যবদ্ধ, দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। দেশের প্রতি ছিল বঙ্গবন্ধুর সীমাহীন আবেগ, অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসা। তথাকথিত পুঁজিবাদী এলিট শ্রেণি, ধর্ম ব্যবসায়ী ও ১৯৭১ সালে পরাজিত শক্তি প্রতিশোধ স্পৃহায় জ্বলতে থাকা গোষ্ঠীর সম্মিলিত চক্রান্তের ঘৃণ্য ফসল বাঙালির প্রাণের স্পন্দন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা। অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় সফল হলেও কায়েমী স্বার্থগোষ্ঠী তার আদর্শ হত্যা করতে সফল হয়নি। বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান পাওয়া বঙ্গবন্ধু আরো প্রাসঙ্গিক ও দীপ্তমান হয়েছেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে।
বঙ্গবন্ধুর শোষণমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আঘাত হেনেছে বারবার। যে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন জাতির পিতা দেখিয়েছিলেন, তাতেও কুঠারাঘাত এসেছিল বারবার। এই কায়েমী স্বার্থগোষ্ঠী আজও সরব। দেশে এবং বিদেশ থেকে ষড়যন্ত্রের নানা জাল বুনছে। এসব ষড়যন্ত্রকে সমূলে ধ্বংস করতে এই প্রজন্ম রাখতে পারে অগ্রণী ভূমিকা। জাতির জনকের আদর্শ ধরে রাখতে হলে সততা ও নৈতিকতার আদর্শিক ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটিয়ে কর্তব্যপরায়ণ ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ নিজ অবস্থানে অবদান রেখে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। এই মুক্তি অর্জনে প্রয়োজন সত্যিকার দেশপ্রেম। বর্তমান তরুণ প্রজন্ম দায়িত্ববোধ ও দেশপ্রেমের মহান দীক্ষায় এগিয়ে যেতে পারলেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সমুন্নত রাখা হবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই ইতিহাসের প্রতিটি পর্বে তরুণরা ছিল অগ্রসেনানী। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে নির্বাচন, ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা, সবকিছুতেই ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, ছিল তারুণ্যের তেজোদ্বীপ্ত কণ্ঠ, ছিল সাহসী পদচারণা। ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ, এরপরই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল হিসেবে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে জনগণের সংগঠন হয়ে উঠে আওয়ামী লীগ। যেখানে তরুণদের ভূমিকা ছিল অনেক। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে দীক্ষিত হয়ে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিক নেতৃত্বের গুণাবলি ধারণ করে একটি পরিশীলিত ও পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরিতে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থে তাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সামনে উপস্থাপনের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার দায়িত্ব নিতে হবে এই প্রজন্মের তরুণদেরই। পরাজিত ও পথভ্রষ্ট শক্তিকে বাঙালি জাতি যেভাবে পরাজিত করেছিল, তার ইতিহাস তরুণ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার মহান কাজটি করতে হবে তরুণ প্রজন্মকেই। এখনো একটি শক্তি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির নগ্ন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নানাভাবে। অনেক ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তির চেষ্টা করা হচ্ছে, যা রুখে দিতে এই তরুণ প্রজন্মকেই সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ইতিহাস বিকৃতির সব চেষ্টাকেই প্রতিহত করার দৃঢ় সংকল্প রাখতে হবে প্রজন্মের এই প্রতিনিধিদের। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করা অন্যায়, স্বার্থপরতা, শ্রেণি শোষণ, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি প্রভৃতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর যে আমরণ লড়াই ছিল, সে লড়াই নিজেদের কাঁধে তোলার দায় এই প্রজন্মের। একটি উন্নত, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন বঙ্গবন্ধু। এমন একটি দেশ গড়তে তরুণরাই হোক বড় শক্তি। শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বলীয়ান হয়ে এই প্রজন্ম বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কারিগর হয়ে উঠুক- এটুকুই প্রত্যাশা।
মোঃ আক্তার হোসেন,
শিক্ষক ও গবেষক ।