মো: আক্তার হোসেন, শিক্ষক ও গবেষক
বাংলাদেশে বন্যা একটি নিয়মিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কোনো না অঞ্চলে বন্যা হয়। বন্যার ফলে সৃষ্ট পানি মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত করে তোলার পাশাপাশি নানা স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণও হয়ে দাঁড়ায়। এসব স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সঠিকভাবে মোকাবিলা করাই বন্যার সময়ে সুস্থ থাকার মূল চাবিকাঠি।বন্যার সময় নানা ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। তার ভিতরে অন্যতম হলো পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ।
পানিবাহিত রোগের সংক্রমণ: বন্যার পানি সাধারণত ময়লা ও দূষিত হয়। এই পানির মাধ্যমে বিভিন্ন রোগের জীবাণু সহজেই মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। প্রধান কয়েকটি পানিবাহিত রোগ হলো:
ডায়রিয়া: বন্যার সময় বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে। ডায়রিয়া একটি গুরুতর রোগ, যা শরীরের পানি শূন্যতা ঘটিয়ে প্রাণহানি ঘটাতে পারে।
কলেরা: এই ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত রোগটি দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমে ছড়ায়। কলেরার কারণে তীব্র ডায়রিয়া ও বমি হয়, যা দ্রুত চিকিৎসা না করলে জীবন সংকটাপন্ন হতে পারে।
জন্ডিস (হেপাটাইটিস এ): দূষিত পানির মাধ্যমে এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে এবং যকৃৎকে আক্রমণ করে। এর ফলে চোখ ও ত্বক হলুদ হয়ে যায় এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
টাইফয়েড: টাইফয়েডের জীবাণু সাধারণত দূষিত পানি ও খাবারের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। টাইফয়েড জ্বরে দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, মাথাব্যথা, এবং পেটে ব্যথা হয়।
ত্বকের সংক্রমণ ও চর্মরোগ:
বন্যার পানিতে দীর্ঘক্ষণ ভিজে থাকার কারণে ত্বকে নানা ধরনের সংক্রমণ হতে পারে। বিশেষ করে, পায়ে চর্মরোগ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এছাড়া, খোস-পাঁচড়া, ফোসকা পড়া, এবং ফাংগাল ইনফেকশন হওয়ার ঝুঁকিও থাকে।
শ্বাসকষ্ট ও অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা: বন্যার পানিতে ভেজা ও ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে শ্বাসকষ্ট, সর্দি, কাশি এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
মশাবাহিত রোগ: বন্যার পর পানি জমে থাকা জায়গাগুলোতে মশার বংশবৃদ্ধি হয়, যা ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, এবং চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারে।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: বন্যায় ঘরবাড়ি হারানো, খাদ্য ও পানির সংকট এবং রোগের প্রাদুর্ভাবের কারণে মানুষের মধ্যে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং হতাশা দেখা দিতে পারে। এই মানসিক সমস্যাগুলো অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, যদি তা সময়মতো মোকাবিলা না করা হয়।
বন্যার সময় স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রতিকারে করণীয় :
বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করুন: বন্যার সময় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিতে পারে। তাই, পানি বিশুদ্ধ করার জন্য সহজ উপায় অনুসরণ করতে হবে। যেমন: পানি ভালোভাবে ফুটিয়ে ঠান্ডা করে পান করুন। ক্লোরিন ট্যাবলেট ব্যবহার করে পানি বিশুদ্ধ করে নিতে পারেন। যেকোনো উপায়ে দূষিত পানি এড়িয়ে চলা।
সঠিক স্যানিটেশন ও পরিচ্ছন্নতা: খাওয়ার আগে ও টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে। খাবার ঢেকে রাখতে হবে এবং পঁচা-বাসি খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। বন্যার পানির সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকুন। যদি আসতেই হয়, তাহলে বুট বা পানিরোধক জুতা পরিধান করুন।
মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে সতর্ক থাকুন:
মশারি টানিয়ে ঘুমান এবং দিনে রাতে সবসময় মশা প্রতিরোধক স্প্রে বা ক্রিম ব্যবহার করুন। মশার জন্মস্থান ধ্বংস করতে জমে থাকা পানি সরিয়ে ফেলুন। বিশেষ করে ফুলের টব, বালতি বা অন্য যেকোনো পাত্রে পানি জমে থাকতে দেবেন না।
প্রাথমিক চিকিৎসা কিট তৈরি করুন: প্রাথমিক চিকিৎসা কিটে ব্যান্ডেজ, গজ, অ্যান্টিসেপ্টিক ক্রিম, প্যারাসিটামল, ওআরএস, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধ রাখুন। ত্বকে কোনো আঘাত বা সংক্রমণ হলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা করুন।
খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করুন:
সুস্থ থাকতে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া অপরিহার্য। বন্যার সময় যতটুকু সম্ভব পুষ্টিকর খাবার, যেমন তাজা ফলমূল, শাকসবজি, দুধ, এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ খাদ্য খেতে হবে। পানিশূন্যতা রোধে নিয়মিত পানি পান করতে হবে এবং ওআরএস সেবন করতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য:
নিজের এবং পরিবারের মানসিক সুস্থতার দিকে খেয়াল রাখুন। বন্যার সময় মানসিক চাপ কমাতে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলুন এবং প্রয়োজন হলে পেশাদার কাউন্সেলরের পরামর্শ নিন।
স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শ নিন:
যেকোনো অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শ নিন। প্রয়োজন হলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান এবং চিকিৎসা গ্রহণ করুন।
স্বেচ্ছাসেবী ও উদ্ধারকর্মীদের সাহায্য নিন:
পানি বন্দী মানুষ চাইলেই উপরোল্লিখিত সব রকম নিয়ম মেনে চলার উপায় নেই। ওষুধ ও স্বাস্থ্যকিট তাঁদের হাতের কাছে থাকার কথাও নয়। তাই স্বেচ্ছাসেবী, এনজিও ও উদ্ধারকর্মীদের উচিৎ বন্যার্তদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া, তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির ব্যাপারে সচেতন করার বিষয়টি নিশ্চিত করা। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও ওষুধপত্র পৌঁছে দেওয়ার দিকেও স্বোচ্ছাসেবীদের নজর দেওয়া উচিৎ।
বন্যার সময় সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা এবং সঠিক করণীয় মেনে চলা আমাদের জীবন রক্ষা করতে সহায়তা করে। বিশুদ্ধ পানি, পরিচ্ছন্নতা, মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধ, এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা নিজেদের ও পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখতে পারি। মনে রাখতে হবে, বন্যার সময় সুস্থ থাকতে সতর্কতাই হতে পারে আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।