আনোয়ার সজীব- অর্থনীতিবিদ, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সাধারণ কথায় ‘মুদ্রাস্ফীতি’ বলতে পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে যাওয়াকে বোঝায়, যা সাধারনত অতিরিক্ত মুদ্রা সরবরাহের কারণে ঘটে থাকে। কোনো দেশের সুনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জন্যে , বাজারে পণ্যের মজুদ ও মুদ্রার সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য থাকতে হয়। আর যদি তা না হয় অর্থাৎ পণ্যে’র মজুদের তুলনায় মুদ্রা সরবরাহের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায় [অর্থাৎ উক্ত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অতিরিক্ত মাত্রায় মুদ্রার প্রচলন (যেমন- টাকা ছাপানো) করে] তখনই মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।
এর ফলে একই পরিমান পণ্য ক্রয় করতে ভোক্তা বা ক্রেতাকে পূর্বের তুলনায় বেশি পরিমাণ মুদ্রা খরচ করতে হয়, অর্থাৎ মুদ্রার মান কমে যায়।
উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক, ২০২৩ সালে ১০ কেজি ময়দা ক্রয় করতে ক্রেতার ৫০০ টাকা খরচ হতো। কিন্তু ২০২৪ সালে তাকে একই পরিমাণ (১০ কেজি) ময়দা ক্রয় করতে ৫২৫ টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ক্রেতার বর্তমানে ২৫ টাকা বা ৫% টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। আর এই ৫% ই হলো মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ যার অর্থ টাকার মান ৫% কমে গিয়েছে।
সাধারণত ২ থেকে ৫ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতিকে সহনীয় হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু ৭% থেকে ১০% মুদ্রাস্ফীতি ঘটে থাকলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়। আর যদি মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ ১০ শতাংশের ও বেশি হয়ে থাকে তবে তা উক্ত দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। তবে মুষ্টিমেয় কতগুলো পণ্য ও সেবার দাম বাড়লেই তাকে মুদ্রাস্ফীতি বলা যাবে না। সামগ্রিকভাবে পণ্য/সেবার মূল্য বাড়লেই বুঝে নিতে হবে যে মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে।
মুদ্রাস্ফীতির কারণ:
বিভিন্ন কারণে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে যেমন-
– মুদ্রার সরবরাহ বেড়ে যাওয়া
– চাহিদার তুলনায় পণ্য ও সেবার সরবরাহ অনেক কমে যাওয়া
– কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি অধিক হারে মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে, তাহলে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে; ফলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
– প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা যুদ্ধের কারণে পন্য উৎপাদন ব্যাহত হলে এবং সেবা প্রদান বাধার সম্মুখীন হলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
– বৈদেশিক ঋণের প্রভাবে হঠাৎ করে বাজারে অর্থের সরবরাহ বেড়ে গেলেও মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে।
– ব্যাংকগুলো সুদের হার কমিয়ে দিলে, মানুষ প্রচুর ঋণ নিতে শুরু করে। ফলে মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি পেতে থাকে, যা মুদ্রাস্ফীতির পিছনে বড় কারণ হতে পারে।
– এছাড়াও প্রয়োজনের অতিরিক্ত ভর্তুকি, মজুরি বৃদ্ধি বা বেতন বৃদ্ধি’কে ও মুদ্রাস্ফীতির পিছনে বড় কারণ হিসেবে ধরা হয়। কারণ এতে করে সাধারণ মানুষের হাতে প্রচুর অর্থ চলে আসে, যার কারণে তাদের পণ্য ও সেবার চাহিদা বৃদ্ধি পায়, ফলে মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।
মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল:
মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণই হলো বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বা মুদ্রার প্রবাহ বেড়ে যাওয়া। তাই মুদ্রার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই মুদ্রাস্ফীতি ও নিয়ন্ত্রণে আসতে বাধ্য। আর মুদ্রার সরবরাহ কমিয়ে আনতে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে একটি সু-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির দেশ, নিম্নলিখিত কৌশল গুলো অবলম্বন করে থাকে-
– কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের বিপক্ষে সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। ফলে অতিরিক্ত সুদের হার জনগণের উপরে বর্তায়, ফলে তারা ঋণ নেওয়া কমিয়ে দেয়। তাতে মুদ্রার সরবরাহ কমতে থাকে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
– সরকার কর্তৃক, কর আরোপের পরিমাণ বৃদ্ধি করলে অথবা নতুন নতুন করের খাত সৃষ্টি করলে মানুষের ব্যয়যোগ্য আয়ের পরিমাণ কমে যায়। ফলে বাজারে প্রবেশকৃত অতিরিক্ত মুদ্রা বেরিয়ে যায়, তাতে মুদ্রাস্ফীতির নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
– এছাড়া অনুৎপাদনশীল খাতে খরচ কমিয়ে উৎপাদনশীল খাতে খরচ করতে হবে- তাতে পণ্যের যোগান বৃদ্ধি পাবে, ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে।
আবার বাজারে পণ্যের যোগান বৃদ্ধি করার নিমিত্তে আমদানি খাতে মুদ্রা ব্যয় করা যেতে পারে। এতে করে মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমার সম্ভাবনা থাকে।
মুদ্রাস্ফীতি কার জন্য অভিশাপ, আর কার জন্য আশীর্বাদ?
মুদ্রাস্ফীতি যেমন সমাজে একশ্রেণির মানুষের জন্য বিপদ ডেকে আনে, তেমনি এর ফলে একশ্রেণির মানুষ উপকৃত ও হয়ে থাকে।
– অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, মুদ্রাস্ফীতির সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে স্বল্প আয়ের মানুষের উপর। এর ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায় এবং জীবন হুমকির মুখে পড়ে। পক্ষান্তরে ব্যবসায়ী ও উৎপাদক শ্রেণি মুদ্রাস্ফীতির কারণে লাভবান হয়ে থাকে।
– বছর শেষে যে সকল চাকরিজীবীদের ইনক্রিমেন্ট হয় না বা বেতন বৃদ্ধি পায় না, আর বাড়লেও তা তুলনামূলক নগণ্য হারে বৃদ্ধি পায়- তারাও মুদ্রাস্ফীতির কারণে অভিশপ্ত হয়ে থাকে।
– মুদ্রাস্ফীতির কারণে ঋণ গ্রহীতারা লাভবান হলেও ঋণদাতা গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
সুতরাং বলা যায় যে, মুদ্রাস্ফীতি কিছু কিছু ক্ষেত্রে (প্রেক্ষাপট ভেদে) অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখলেও, অতিরিক্ত ও দীর্ঘমেয়াদি মুদ্রাস্ফীতি কোন দেশের জন্যই মঙ্গলজনক নয়।