আনোয়ার সজীব, লেখক ও কলামিস্ট
বাংলার আকাশ জুড়ে পতপত শব্দে উড়তে থাকা লাল-সবুজের বিজয় কেতনের নাম ই স্বাধীনতা! স্বাধীনতা শব্দটির সাথে মিশে থাকে একটি জাতির চেতনা, আবেগ, ঐক্য, দ্রোহ, পাওয়া, না-পাওয়া’র গল্প। রূপকথার গল্পে’র হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো এক উন্মত্ত সুরে মাতোয়ারা হয়েছিলো গোটা দেশ, আর সেই সুর ভেসে উঠেছিলো মাত্র একটি তর্জনীর ইশারায়। শহর থেকে এমনকি প্রত্যন্ত অজো পাড়া-গাঁ থেকেও ছুটে এসেছিলো কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। বৃদ্ধ, যুবক, নারী, তরুণ-তরুনী’রা এসেছিলো সেই সুরের মূর্ছনায় নিজেকে উজাড় করে দিতে।
যে তর্জনী গোটা দেশ তথা সারা বিশ্বের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলো স্বাধীনতা কাকে বলে? আর কিভাবে তা ছিনিয়ে আনতে হয়? তাইতো টুঙ্গিপাড়া’র সেই ছোট্ট খোকা থেকে ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শীর্ষ মানবসত্তা, সর্বোত্তম পথপ্রদর্শক ও বাঙ্গালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা।
আজ ১৭ মার্চ (রবিবার)-২০২৪, বাঙ্গালি জাতির সেই আলোর দিশারি’র ১০৪ তম জন্মদিন। ১৯২০ সালের এই দিনে শেখ লুৎফুর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাঙালি জাতির সেই বলিষ্ঠ শিশু। আর সেজন্যই সারাদেশে এই দিবসটিকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
১৯২৭ সালে সাত বছর বয়সে গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাতেখড়ি হয় প্রারম্ভিক শিক্ষার। পরে অবশ্য বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক বিদ্যালয়, মাদারীপুর ইসলামিয়া বিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইন্সটিটিউট মিশন স্কুল, গোপালগঞ্জ মিশনারিজ স্কুল, কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন। তিনি ১৯৩৪ সালে বেরিবেরি এবং ১৯৩৬ সালে গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হন, যে কারণে তাঁর অধ্যয়ন জীবনে বেশ প্রভাব পড়ে।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি ছিলেন সুউচ্চ হিমালয়ের ন্যায়, যার আদর্শ ছিলো কৃপাণে জাগানো ধারের মতো। তিনি ১৯৪৬–১৯৪৮ বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের উপদেষ্টা, ১৯৫৩–১৯৬৬ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৫৪ পূর্ববঙ্গের কৃষিমন্ত্রী, ১৯৫৪–১৯৫৮ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, ১৯৫৫–১৯৫৮ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য, ১৯৫৬–১৯৫৭ শিল্পমন্ত্রী, ১৯৬৬–১৯৭৪ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
যৌবনের অর্ধেক সময় তিনি কাটিয়েছেন কারাগারের মধ্যে, বরণ করেছেন মৃত্যুসম যন্ত্রণা! তবুও তিনি বিন্দুমাত্র থমকে দাঁড়াননি পিছু হটার জন্য। জীবনের শেষ অবধি তিনি গেয়েছেন মানবতার গান, বিলিয়েছেন স্বার্থহীন ভালোবাসা, আপন করে বুকে জড়িয়েছেন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষদের। কারারুদ্ধ জীবনে তাঁর স্বর্গীয় সারথি বেগম ফজিলাতুন্নেছা’র অনুপ্রেরণায় লিখে গেছেন জীবন্ত ডায়েরি, যা অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়-সমাদৃত হচ্ছে বিশ্ব দরবারে।
ব্রিটিশ বিরোধীসহ জাতীয় সকল আন্দোলনে তিনি রেখেছেন অসামান্য অবদান, ৭ই মার্চ দিয়েছিলেন বাঙালি জাতির মুক্তির চূড়ান্ত মূলমন্ত্র। বজ্রকন্ঠে হুঙ্কার তুলে বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তারপর থেকেই একটু একটু করে লাল টুকটুকে সূর্যটা, বাংলার সবুজ প্রকৃতির বুক চিড়ে উদিত হতে আরম্ভ করলো। অবশেষে ভোর এসেছিলো বাংলার ঘরে-ঘরে, তাঁরই হাত ধরে।