
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলাটি ঘটে থাকে ২০১৬ সালের ১ জুলাই। ওই রাতে গুলশান-২ এর হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালিয়ে জঙ্গিরা দেশি-বিদেশি ২২ জন নাগরিককে হত্যা করে। এর মধ্যে ইতালির ছিল নয়জন, জাপানের ছিল সাতজন, ভারতের ছিল একজন, আমেরিকার একজন, বাংলাদেশি দুইজন নাগরিক ও দুইজন পুলিশ কর্মকর্তরা ছিলেন। এছাড়া পুলিশ এবং সেনাবাহিনী মিলে দেশি-বিদেশি মোট ৩২ জন নাগরিককে উদ্ধার করা হয়ে থাকে।
ওই হামলার আজ সাত বছর পূর্ন হয়েছে। দিনটিতে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় নিহতদের স্মরণে পুলিশের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। প্রতি বছরের মতো আজও সকালে গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর রোডের হলি আর্টিজানে নিহতদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।
সেই রাতে কী হয়েছিল
২০১৬ সালের ১ জুলাই দিনটি ছিল শুক্রবার।
ওই দিন রাত ৯টা বেজে ৫ মিনিট গুলশান ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের হামলার খবর পায় পুলিশ। রাত ৯টা ২০ মিনিটে ঘটনাস্থলে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান সেখানকার প্রত্যক্ষদর্শীরা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে গোলাগুলিতে আহত হন বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।রাত ১০টার দিকে পুলিশ, র্যাব ও আধা সামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ডস বাংলাদেশের কয়েকশ সদস্য ঘটনাস্থলে গিয়ে অবস্থান নিয়ে থাকে। গণমাধ্যম কর্মীরাও ৭৯নং রোডের মাঝামাঝির স্থানে অবস্থান নেন।
রাত সোয়া ১১টার দিকে হাসপাতালেই মারা যান বনানী থানার ওসি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন। রাত চারটা পর্যন্ত অস্ত্রধারীদের সাথে কোনো যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
ওই দিন রাতেই ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের বার্তা সংস্থা বলে পরিচিত 'আমাক'-এ গুলশান হামলার দায় স্বীকার করে ২০ জন নিহত হওয়ার কথাও জানিয়ে থাকে।
আইএস এর পক্ষ থেকে হামলাকারীদের মধ্যে পাঁচজনকে তাদের 'সৈনিক' বলেও দাবি করে, হামলার দায় নেয় তারা।
পরদিন ২ জুলাই সকালে সেনা, নৌ, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে যৌথ কমান্ডো দল গুলশানে অভিযানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেয়। ওই দিন সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে কমান্ডো বাহিনী অভিযান শুরু করে। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দলের সদস্যরা রেস্টুরেন্টের ভেতরে প্রবেশ করে। এসময় গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। সকাল সোয়া ৮টায় রেস্টুরেন্ট থেকে প্রথম দফায় নারী এবং শিশুসহ ছয়জনকে বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। পাশের একটি ভবন থেকে একজন বিদেশি নাগরিক তার মোবাইল ফোনে সেটি ধারণ করেন। ৮টা ৫৫ মিনিটে ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেয় অভিযানকারীরা। গোয়েন্দা দল ভবনের ভেতর বিস্ফোরকের জন্য তল্লাশি শুরু করে। কিছুক্ষণ পরেই আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু করে গোয়েন্দারা।
৯টা ১৫ মিনিটে অভিযান শেষ হয়। কমান্ডো অভিযানের মধ্য দিয়ে ঢাকার গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে প্রায় ১২ ঘণ্টার এই রক্তাক্ত জিম্মি সংকটের অবসান হয়। সকাল ১০টায় চারজন বিদেশিসহ ১৩ জন জীবিত উদ্ধারের খবর জানানো হয়ে থাকে। রেস্টুরেন্টের ভেতরে অজ্ঞাত পাঁচজনের মৃতদেহ পাওয়ার কথা পুলিশ জানিয়ে থাকে। দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে আইএসপিআর থেকে এক সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়- রেস্টুরেন্ট থেকে ২০টি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।
যে কারণে এবং যেভাবে হামলার পরিকল্পনা
বাংলাদেশে জঙ্গি উত্থান হয়েছে, সারা বিশ্বকে এমন তথ্য জানানোর জন্য এই হামলা করা হয়েছিল। তবে হামলা করার আগে গত বছর এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে এই হামলার পরিকল্পনা করে থাকে জঙ্গিরা।
হামলার আগে জঙ্গিরা একটি পরিকল্পনা করে। এতে ঢাকা নগরী সম্পর্কে ধারণা আছে এমন তিনটি ছেলেকে বাছাই করা হয়। এছাড়া আরও দুটি ছেলেকে গ্রাম থেকে বাছাই করা হয়েছে। হামলাকারী বাছাই শেষে ওই পাঁচজনকে গাইবান্ধায় পাঠানো হয়। সেখানে তাদের দেয়া হয় বিশেষ প্রশিক্ষণ। ২৮ দিন প্রশিক্ষণ শেষে তাদের পাঠানো হয়েছিল ঢাকায়।
হলি আর্টিজান কেন টার্গেটে
পাঁচ জঙ্গিকে গাইবান্ধা থেকে প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় আনা হয়। একই সাথে চলতে থাকে গুলশান-বারিধারার সুবিধাজনক এলাকায় টার্গেট বাছাইয়ের কাজ। এক পর্যায়ে হামলার উপযুক্ত টার্গেট হিসেবে বেছে নেওয়া হয় গুলশান ২ এর ৭৯ নম্বর রোডের হলি আর্টিজান এর এই বেকারিকে। বেকারিটি হামলার উপযুক্ত টার্গেট হওয়ার মূল কারণ এতে প্রচুরসংখ্যক বিদেশি অতিথিদের আনাগোনা ছিল।
যেভাবে হামলায় অংশ দেয় ৫ জঙ্গি
হামলাকারীরা বসুন্ধরা এলাকার বাসা থেকে প্রথমে রিকশা এবং পরে পায়ে হেঁটে হলি আর্টিজানে আসে। এই সময় তাদের কাঁধে ব্যাগ আর পরনে ছিল টিশার্ট-জিনস ও কেডস। আউটফিট এমন ছিল যাতে প্রয়োজনের মুহূর্তে দ্রুত মুভ করা যায়।
ভিকটিমদের মোবাইল ব্যবহার
হলি আর্টিজান বেকারিতে আসার সময় হামলাকারীরা তাদের সাথে করে নিজস্ব কোনো মোবাইল বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসকে নিয়ে যায়নি। যতক্ষণ তারা হলি আর্টিজানের ভেতরে অবস্থান করছিল ততক্ষণ তারা ভিকটিমদের মোবাইল এবং আইপ্যাড ব্যবহার করে ছবি তুলে মিরপুরের শেওরাপাড়ায় অবস্থানরত তামিম চৌধুরী ও নুরুল ইসলাম মারজানের কাছে পাঠিয়ে থাকে। তবে পরবর্তী সময়ে সোয়াট এবং পুলিশের আলাদা অভিযানে নিহত হয়েছেন তামিম চৌধুরী এবং নুরুল ইসলাম।
যেভাবে সংগ্রহ করা হয় হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র
হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্র এবং বিস্ফোরকসমূহের মূল যোগান আসে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং যশোর সীমান্ত দিয়ে। এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান। তবে পরবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাকে।
আসামিদের সাজা
২০১৯ সালের ৭ ডিসেম্বর ঢাকার একটি আদালত সাত জঙ্গিতে মৃত্যুদণ্ড ও একজনকে খালাস দেন। পরে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা। গত মে মাসে ডেথ রেফারেন্স এবং আপিল শুনানি শুরু হয় হাইকোর্ট বেঞ্চে।
প্রকাশক: মনসুর মো. এন হাসান
সম্পাদক: মো. আশরাফুল ইসলাম
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী-সম্পাদক: আনোয়ার সজীব