ঢাকা, সোমবার, ১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

নিষিদ্ধ নজরুল বাজেয়াপ্ত যুগবাণী

জাফর ওয়াজেদ

“স্বাধীনতা হারাইয়া আমরা যখন আত্মশক্তিতে অবিশ্বাসী হইয়া পড়িলাম এবং আকাশমুখো হইয়া কোন অজানা পাষাণ দেবতাকে লক্ষ্য করিয়া কেবলি কান্না জুড়িয়া দিলাম; তখন কবির কণ্ঠে আকাশবাণী দৈববাণীর মতোই দিকে দিকে বিঘোষিত হইল, ‘গেছে দেশ দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ।’ বাস্তুবিক আজ আমরা অধীন হইয়ছি বলিয়া চিরকালই যে অধীন হইয়া থাকিব, এরূপ কোনো কথা নাই। কাহাকেও কেহ কখনো চিরদিন অধীন করিয়া রাখিতে পারে নাই ইহা প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ।” (যুগবাণী:নজরুল)। অধীনতা মেনে নেওয়া নজরুল জীবনে ছিল অকল্পনীয়। বাল্য থেকেই স্বাধীনচেতা মনোভাব তাকে সাহসী, ব্রতী, সংগ্রামী, লড়াকু, দৃঢ় মনোবলের অধিকারী করেছে। জন্মেছিলেন পরাধীন দেশে। উপনিবেশ শাসনের ভেতর দেখেছেন শোষিত, বঞ্চিত পরাধীন এক জাতিকে। এক আত্মগরিমাহীন জাতি ক্ষয়িষ্ণু, দারিদ্র্য আর অশিক্ষা, কুসংস্কারে তলিয়ে যাচ্ছে। ১৮৯৯ সালে রাঢ়বঙ্গে জন্ম নেয়া কাজী নজরুল ইসলাম শৈশবেই মুখোমুখি হয়েছেন দারিদ্রের। নামতে হয়েছে রোজগারে। শিশু শ্রমিক থেকে কিশোর শ্রমিক জীবনের মাঝে শিক্ষার আগ্রহ থেকে দূরবর্তী হননি। দশম শ্রেণীর ছাত্র যখন, তখনই স্বাধীনচেতা নজরুল পথ খুঁজে নিলেন। সৈনিকের খাতায় নাম লেখালেন। সশস্ত্র পথে দেশমাতার স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্নে তখন টগবগে।
পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন নজরুল। আর এই চাওয়াটা তার পুরো জীবন ধরেই ছিল। নজরুল মূলত চেয়েছিলেন স্বাধীনতা। স্বরাজ নয়। বলেছেন, “স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেন না ওকথাটার মানে এক-এক মহারথী এক-এক রকম করে থাকেন, ভারতবর্ষের এক-পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার-সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোন বিদেশীদের মোড়লীর অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।….. আমাদের এই প্রার্থনা করার ভিক্ষা করার, কুবুদ্ধিটুকু ছাড়তে হবে।” স্বাধীনতা প্রাপ্তির যে কোন সক্রিয় পথের শরিক হতে নজরুল পা বাড়িয়েছেন সব সময়। সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে যাবার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বয়স যখন তার ১৮, তখন তিনি প্রথম মহাযুদ্ধের সৈনিক। স্বপ্ন তখন তাকে হয়তো আলোড়িত করেছে, দেশ ও জাতির মুক্তি। সে পথ সশস্ত্র হতে পারে। কারণ যখন তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, দেশ জুড়ে তখন স্বদেশী আন্দোলনের জোয়ার। সশস্ত্র সংগঠনও গড়ে ওঠেছে বাংলায়। আবার এই নজরুলই গান্ধীবাদকেও অভিনন্দন জানিয়েছেন। পাশাপাশি সন্ত্রাসবাদকেও করেছেন অভিনন্দিত। আবার যখন গণজাগরণের সাম্যবাদ এসেছে, সে ও হয়েছে কবিরও নান্দীপাঠক।
নজরলের ক্ষুধা ছিল সামগ্রিক ক্ষুধা অর্থাৎ সমাজের সকল স্তরে মানুষের স্বাধীনতা। মানুষে মানুষে বৈষম্যও তাকে পীড়িত করেছিল। আসে নজরুলের দেশপ্রেম দুর্দম, তার নিজের মতোই। অন্য কারো সাথে তা তুলনীয় নয়। তার কোন দলের জ্ঞান ছিল, এমন নয়। সকলকে সমান অধিকারে স্বাধীন মানব হিসেবে দেখার উদগ্র বাসনা এবং তাদের সঙ্গে গলাগলি হয়েই সেই স্বাধীনতা অর্জন করতে চেয়েছিলেন তিনি। নজ নজরুলের কাজে প্রাপ্তিই ছিল পরম চাওয়া। পথ বা পদ্ধতি নিয়ে টানাপোড়েন তেমন দেখা দেয়নি। যে পথেই হোক স্বাধীনতা চাই। এই একগুঁয়ে মনোভাব ছিল তীব্র। তাই গান্ধীর ডাকে চরকাও ঘুরিয়েছেন। কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছেন। জগতের লাঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের উত্থানের গান গেয়েছেন। শোষণ, শাসন, ত্রাসনের বিরুদ্ধে হাত উজার করে গদ্য পদ্য লিখেছেন। বাংলা সাহিত্যে নজরুলই প্রথম কবি, যিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন, নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন স্বাধীনতার সপক্ষে জোরালো জনমত গঠনে। আর এতেও ছিল তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক কর্মী এবং সাংবাদিক নজরুলের চেয়ে সৃজনশীল সৃষ্টিশীল কবি হিসেবে ছিলেন আরো উঁচুস্তরের। কিন্তু রাজনীতি ও সাংবাদিকতা-এ দুটো মাধ্যমই ছিল তার উপনিবেশিকতার বিপরীতে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রগঠন এবং সাম্যবাদী ধারায় দেশ পরিচালনার স্বপ্ন। যুগের হাওয়ায় নজরুল ইসলাম নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। একাই নিজের বাণী বহন করেছেন। নিজস্ব চিন্তা, চেতনা, ভাবনাকে সামনে এগিয়ে নিতে একাই লড়েছেন, অদম্য সাহসে। সাহস তার সঞ্চিত হয়েছিল বাল্যকালে। যখন অজস্র জনতার উপস্থিতিতে বাল্যবয়সে লেটো দলে গান গাইতেন। গানবাধা, সুর দেওয়ার কাজটি তখন থেকেই শুরু। আর এই গান গাওয়ার সুবাদে সমাজ চেতনা, জনজীবনের দুঃখ-কষ্ট হাসি কান্নাকে আত্মস্থ করার প্রক্রিয়ারও শুরু তখন।
১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে ইংরেজ আর জার্মানীর মধ্যে। ইংরেজদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ থেকে যুবশক্তিকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ শুরু হয়। ইংরেজ শাসকরা বাংলার দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার টানিয়ে দেয় সোনাবাহিনীতে যোগদানের আহবান জানিয়ে। পোস্টারে উলে­খ করা হয়, “কে বলে বাঙালি যোদ্ধা নয়? কে বলে বাঙালি ভীতুর জাতি? এই কলঙ্ক মোচন করা অবশ্য কর্তব্য। আর তা পারবে একমাত্র বাংলার যুবশক্তি। ঝাঁপিয়ে পড় সিংহবিক্রমে। বাঙালি পল্টনে যুব শক্তি।” আঠারো বছরের নজরুল উদ্বুদ্ধ হলেন। দেশকে স্বাধীন করতে হলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন-এই ভাবনা তাকে এমনই আলোড়িত করলো যে, দশম শ্রেণীর মেধাবী ছাত্রটি আসন্ন ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশ না নিয়ে চলে গেলো বাঙালি পল্টনে। উনপঞ্চাশ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিয়ে চলে গেলেন পেশোয়ারে প্রশিক্ষণে। প্রশিক্ষণ শেষে মেসোপটেমিয়া যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যের পক্ষে লড়াই করার জন্য করাচির সেনাছাউনীতে শুরু হলো অপেক্ষমান জীবন। এখানে কর্মকুশলতায় পদোন্নতি পেয়ে হয়ে গেলেন হাবিলদার নজরুল। কিন্তু সৈনিক জীবনের কঠোর নিয়মানুবর্তীতায় হাঁফিয়ে ওঠেন দুর্দম স্বাধীনচেতা নজরুল। তবু সেখানেই পেয়ে গেলেন শিক্ষা-সংস্কৃতির এক নতুন দিগন্ত। ফার্সী, উর্দু, হিন্দী ভাষাটা রপ্ত হয়ে যায় এ সময়। ওমর খৈয়াম, হাফিজের কাব্য মূল ফার্সীতে পাঠের আনন্দ তার কবিসত্বাকে আলোড়িত করে। করাচীতেই শুরু হয় তার নতুন করে কাব্যচর্চা। সেই সঙ্গে গল্প, উপন্যাস রচনার কাজে হাত দেন। কলকাতার কাগজে কবিতা ছাপা শুরু হয়। ১৯১৯ সালে মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে বাঙালি সেনাদের প্রয়োজন ফুরায়। ১৯২০ সালে বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে দেয়া হয়। সৈনিকদের বিভিন্ন পদে চাকরি দেয়া হয়। কিন্তু চাকরি পেয়েও নজরুলের আর যোগ দেয়া হয়নি। কলকাতায় বন্ধু মুজফফর আহমদের সাহচর্য তাকে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার সপক্ষে সংগ্রামের লড়াকু সৈনিক করে তুলে। দেশমাতৃকার মুক্তির আকাঙ্খা হয়ে ওঠে তীব্র। দু’জনেই রাজনীতি করার ব্রত নিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, সংবাদপত্র প্রকাশের। এবং তা সান্ধ্য দৈনিক। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের অর্থায়নে নজরুল ও আহমদের যৌথ সম্পাদনায় ১৯২০ সালের ১২ জুলাই ‘নবযুগ’ বাজারে এলো। প্রথম সংখ্যা থেকেই তা পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাংবাদিকতার কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা নজরুল তখন একুশ বছর বয়সী। নিজের সহজাত তীক্ষ্ণ মেধা, কাব্যরুচি, রাজনৈতিক বোধ এবং প্রখর কান্ড ও নীতিজ্ঞান তাকে সাংবাদিক হিসেবে সামনে আসার পথ তৈরি করে দেয়। দৈনিক পত্রিকায় লেখার অভিজ্ঞতা না থাকা এই দু’জনে তখন অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। নজরুল বড় বড় প্রতিবেদনগুলো সম্পাদনা শুধু নয়, সংক্ষিপ্তাকারে নিজের ভাষায় লিখতেন। পত্রিকায় শিরোনাম দিতেন বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়েও।
নবযুগ পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণ নজরুলের রচনা। স্বাধীনতার পক্ষে তার কলম তখন জোরালো। তার লেখার জন্যই ব্রিটিশ সরকার ‘নবযুগ’ প্রকাশক ফজলুল হককে সতর্ক করে দিয়েছিল বার তিনেক । কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যই যাদের লক্ষ্য, তারা থেমে থাকবে কেন। নজরুলের একটি জ্বালাময়ী প্রবন্ধের কারণে সরকার পত্রিকার জামানত এক হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত করেছিল। নতুন করে অনুমতি পেতে ২ হাজার টাকা জমা দিয়ে আবার ‘নবযুগ’ প্রকাশ করা হলেও তারা তা বেশিদিন চালান নি। সাত মাস পর ১৯২১ সালের জানুয়ারী মাসে তারা নিজেরাই পত্রিকা ছেড়ে দেন। অবশ্য পরে নতুন মালিকানায় নবযুগ প্রকাশ হলে নজরুল তাতে যোগ দিয়েও বেশীদিন থাকেন নি নীতিগত কারণে। নজরুল ততোদিনে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা সম্বলিত ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় ‘যুগবাণী’ নামক প্রবন্ধগ্রন্থ। ‘নবযুগ’ পত্রিকায় সাত মাসে প্রকাশিত সম্পাদকীয় ও অন্যান্য নিবন্ধগুলো থেকে বাছাই করে ২১ টি প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশ করেন ‘যুগবাণী’ সংকলন গ্রন্থ। নজরুল কবি হিসেবে পরিচিতির পাশাপাশি সাংবাদিক ও কলাম লেখক হিসেবে আবির্ভূত হবার সাথে সাথে পাঠক হৃদয় জয় করেছিলেন। তার ক্ষুরধার কলম সাহস করে সেইসব কথাই বলেছে, যা নিপীড়িত, লাঞ্চিত, পরাধীন মানুষের অন্তরের কথা। তিনি তাদের মধ্যে জাগরণের মন্ত্র তুলে দিয়েছেন। যে সব লেখার কারণে ‘নবযুগ’ রাজরোষে পড়েছিল, সে সব লেখার সংকলন প্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যে তা সরকার নিষিদ্ধ করে। বিস্ময়কর যে, এই নিষেধাজ্ঞা ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট পর্যন্ত বহাল ছিল। নজরুলের প্রথম গদ্যগ্রন্থটিই শুধু বাজেয়াপ্ত হয়নি, তার আরো দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থও পরবর্র্তীকালে বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ‘রুদ্রমঙ্গল’ (১৯২৬) প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হয়। এটিও দেশভাগের পর মুক্ত হয়। ১৯২৬ সালে প্রকাশিত অপর প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘দুর্দিনের যাত্রী’ রও একই ভাগ্য ঘটে।
নজরুলের গ্রন্থ সংখ্যা ৫৩ টি। এর মধ্যে প্রবন্ধ গ্রন্থ তিনটি ছাড়াও বাজেয়াপ্ত হয় চারটি কাব্যগ্রন্থ, ‘বিষের বাঁশী’ (১৯২৪), ‘ভাঙ্গার গান,’ ‘প্রলয়শিখা’ (১৯৩০) ‘চন্দ্রবিন্দু’ (১৯৩০)। প্রথম দু’টি প্রকাশের সাথে সাথে এবং পরের দু’টি একছর পর ১৯৩১ সালে বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই গ্রন্থগুলোর একটিও নজরুলের অসুস্থতা পূর্ব সময়ে আর প্রকাশিত হয়নি। নজরুলের আরো কয়েকটি গ্রন্থ বাজেয়াপ্তের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে তা করা না হলেও সেগুলোর বিক্রয় ও প্রচারে পুলিশী বাধা অক্ষুণœ ছিল। ‘যুগবাণী’ গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধ ‘নবযুগ’। যা ছিল পত্রিকার নাম। লিখেছেন নজরুল, “আজ নারায়ণ মানব। তাহার হাতে স্বাধীনতার বাঁশি। সে বাঁশির সুরে সুরে নিখিল মানবের অনুপরমাণু ক্ষিপ্ত হইয়া সাড়া দিয়াছে। আজ রক্ত প্রভাতে দাঁড়াইয়া মানব নব প্রভাত ধরিয়াছে- ‘পোহাল পোহাল বিভাবরী, পূর্ব তোরণে শুনি বাঁশরি, এ সুর নবযুগের। সেই সর্বনাশা বাঁশির সুর রাশিয়া, আয়ারল্যান্ড শুনিয়াছে, তুর্ক শুনিয়াছে এবং সেই সঙ্গে শুনিয়াছে আমাদের হিন্দুস্থান। জর্জরিত, নিপীড়িত, শৃঙ্খলিত ভারতবর্ষ। ” নজরুলের লক্ষ্য কী ছিল তা এই লেখায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নজরুলের প্রথম গ্রন্থটি বেরিয়েছিল ১৯২২ সালে ফেব্রæয়ারী মাসে, গল্পগ্রন্থ ‘ব্যথার দান’। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ কে বাজেয়াপ্ত করার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু করা হলো কবির প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ। প্রকাশের ২৮ দিনের মাথায় ২৩ নভেম্বর।

>>>  অধ্যাপক আবু সাইদের জন্য...

অসহযোগ আন্দোলনে দেশ তখন তুঙ্গে। বৃটিশ উপনিবেশ বিরোধী মনোভাব তীব্রতর। শাসক গোষ্ঠী নিপীড়নের পথ বেছে নেয়। সেই সাথে নেতাদের গ্রেফতার। আর তাদের ১৭৯৯ সালের ১৩ মে চালু করা ‘প্রেস রেগুলেশন এ্যাক্ট’ বলবৎ করে। রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও অশ্লীলতার অভিযোগ এনে বহু বই-পুস্তক, নাটক, কবিতা, গান, লিফলেট, সাময়িকীপত্র, এমনকি গ্রামোফোন রেকর্ডও বাজেয়াপ্ত করা হয়। বঙ্কিম, দীনবন্ধু, মুকুন্দ দাস, গিরীশচন্দ্র, শরৎচন্দ্রের গ্রন্থ বাজেয়াপ্তের ধারায় কবি নজরুলের গ্রন্থও বাজেয়াপ্ত হয়। তবে তার গ্রন্থই সর্বাধিক বাজেয়াপ্ত হয়। ৭টি পুরোপুরি আর ৫টির প্রচার ও বিক্রয়ে অলিখিত বাধা প্রদান করা হয়। পুলিশ নিষিদ্ধ না থাকা সত্বেও তল্লাাশি চালিয়ে বই আটক করতো। নজরুলের জানা ছিল, বৈপ্লবিক আন্দোলন ও মুক্তিসংগ্রামে অপরিসীম প্রভাব সৃষ্টির অভিযোগে বৃটিশরা এদেশে ধর্মগ্রন্থ ‘ভগবদগীতা’ ও ‘চন্ডী’ চূড়ান্ত নিষেধ না করেই তল­াশি চালিয়ে জব্দ করেছে। পূর্ববঙ্গ এমনকি আসামপ্রদেশ থেকেও নজরুলের বই তল্লাশি করে জব্দ করা হয়েছে। ইংরেজ শাসক প্রথমে বাজেয়াপ্ত করে নজরুল সম্পাদিত ‘ধুমকেতু’ পত্রিকা। এই পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামে কবিতা প্রকাশের জন্য। এর পর বাজেয়াপ্ত করে যুগবাণী গ্রন্থটি। গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হয়। এর প্রকাশক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে , গ্রন্থকার। নেপথ্যে যদিও পেশাদার প্রকাশনা সংস্থা ছিল। গ্রন্থটি যে উপনিবেশিক সরকারের ভিত নাড়িয়ে দিতে পারে এমন ধারণাতো প্রবন্ধগুলো নবযুগে প্রকাশের সময়ই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে নব্বই বছর আগে নজরুল লিখলেন সম্পাদকীয়। “খুব সোজা করিয়া বলিতে গেলে নন কো-অপারেশন হইতেছে বিছুটা বা আলকুসি, এবং আমলাতন্ত্র হইতেছেন ছাগল। ছাগলের গায়ে বিছুটি লাগিলে যেমন দিদ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া ছুটাছুটি করিতে থাকে, এই আমলাতন্ত্রও তেমন জ্বালায় বেসামাল হইয়া ছুটাছুটি আরম্ভ করিয়া দিয়াছেন। কিছুতেই যখন জ্বলন ঠান্ডা হয় না তখন ছাগ বেচারী জলে গিয়া লাফাইয়া পড়ে দেওয়ালে গা ঘসিতে থাকে, উলটো ঘসাঘসির চোটে তাহার চামড়াটি দিব্যি ক্ষৌরকর্ম করার মতই লোম শূন্য হইয়া যায়। আমলাতন্ত্রের গায়েও বিছুটা লাগিয়াছে এবং তাই তিনি কখনো জলে নামিতছেন; কখনো ডাঙ্গায় ছুটিতেছেন, আর কখনো বা দেওয়ালে গা ঘেঁসড়াইয়া খামকা নিজেরই নুনছাল তুলিতেছেন। তবু কিন্তু জনবল থামিতেছে না; বরং ক্রমেই বাড়িতেছে।….তাঁহারা যেসব বুদ্ধির পরিচয় দিতেছেন তাহার সকলগুলির পরিচয় দিতে হইলে একটি মস্তকান্ড ‘আমলায়ণ’ লিখিতে হয়। তবে সব চেয়ে ঝাঁজালো বুদ্ধিটা দেখাইতেছেন যাহার-তাহার যে কোন সময় সটান মুখ বন্ধ করিয়া দিয়া।” নিজের গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হবার পর তা গোপনে বিক্রি হলেও নজরুল কোন রয়্যালিটি পেতেন না। ‘মুখবন্ধ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে নজরুল বাঙালির প্রাণের আর্তিকে তুলে ধরেছিলেন। যখন নেতারা সাহস করে সত্য উচ্চারণ নয়, শাসকের তল্পিবাহক বা মোসাহেবীতে লিপ্ত, নজরুল সেখানে সাহস করে গণজাগরণের পথনির্দেশনাই দিলেন। লিখলেন, “জোর জবরদস্তি করিয়া কি কখনও সচেতন জাগ্রত জন-সংঘকে চুপ করানো যায়? বালির বাঁধ দিয়া কি দামোদরের স্রোত আটকানো যায়? যতদিন ঘুমাইয়া ছিলাম বা কিছু বুঝি নাই ততদিন যাহা করিয়াছ সাজিয়াছে। এতদিন মোয়া দেখাইয়া ছেলে ভুলাইয়াছ এখনও কি আর ও রকম ছেলেমানুষী চলিবে মনে কর? আমাদের বড় ভয় হয়, এ মুখবন্ধ আমাদের নয় তোমাদের। আশা করি আমাদের এ ভয় মিথ্যা হইবে না। ইংরেজি রাজত্বে ইংরেজের বিরুদ্ধে এভাবে সরাসরি ক্ষোভ, বিষোদগার প্রকাশের সাহস নজরুলই দেখিয়েছিলেন।

>>>  জিহ্বা পুড়ে গেলে কী করণীয়

বাজেয়াপ্তের পরও বইটি গোপনে ছাপা ও বিক্রির কাজটি চলছে। ফৌজদারী আইনের ৯৯- এ ধারানুযায়ী বাজেয়াপ্ত গ্রন্থটি সম্পর্কে ১৯৪১ সালেও হুঁশিয়ারি সংকেত দেয়া হয়েছিল পুলিশের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। এমনিতে সরকারি গোয়েন্দারা নজরুলের উপর তীক্ষè নজর রাখতো। তার সকল কাজের উপর তাদের দৃষ্টিতে ‘আপত্তিকর’ বিষয়গুলো উত্থাপন করে নানা সুপারিশ করতো পুলিশেরা গোয়েন্দা বিভাগ। গোয়েন্দা প্রতিবেদনের উল্লেখ করে পুলিশ কমিশনার চীফ সেক্রেটারিকে যে প্রতিবেদন পাঠান. তাতে উল্লেখ করেছেন যে, I have examined the book ‘yugabani’. It breathes bitter racial hatred directed mainly against the British preacheg revolt against the existing administiaton in the Country …..I do not think it would advisable to remove the ban on this book in the present crisis. on the whole it is a dangerous book, forceful and kindictive”   বাস্তবতা হচ্ছে, নজরুলের রচনায় তখন যুগমানসই প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক সামাজিক পটভূমিতে নজরুল ছুটে এসেছিলেন ঝোড়ো হাওয়ার বেগে। বাংলা সাহিত্যে নিয়ে এলেন চির বিদ্রোহের বাণী। সংবাদপত্রের মাধ্যমে গণজাগরণের দিশা তুলে ধরলেন। কেবল লেখার মধ্য দিয়ে নজরুল দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করেন নি, জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গেও তার ছিল প্রত্যক্ষ যোগ। বিপ্লবীদের সঙ্গে ছিল তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর দেশে দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈপ্লবিক আন্দোলন মাথাচাড়া দেয়, তার পেছনে তার লেখনীর প্রেরণা অনস্বীকার্য। একদিকে রাজনৈতিক কার্যকলাপ ও অপরদিকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা সমকালীন আর কোনো কবির মধ্যে মেলেনি। এই তৎপরতাই নজরুলকে বৃটিশ শাসকের চোখে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে মূল্যায়িত করেছে । তাই তার কন্ঠরোধ করার জন্য শাসকরা বারবার তৎপর হয়েছে। কারাগারে আটকাবস্থায় ‘স্নো পয়জন’ দিয়েও নিরস্ত করা যায়নি। শাসক চেয়েছিলেন কারাগারে অনশনে কবির মৃত্যু ঘটুক। কিন্তু রবীন্দ্রনাথসহ দেশবাসী চায়নি বলেই নজরুলকে অনশন ভঙ্গ করতে হয়েছিল। এটাতো আজকের সময় এসে বলা যায়, একজন লেখক-সাংবাদিক হিসাবে সমসাময়িককালে নজরুল ইসলামের রচনাই সবচেয়ে বেশি শাস্তিপ্রাপ্ত। নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে তাকে বন্দির হাজারো প্রচেষ্টা চলেছে। কিন্তু নজরুল কোনোভাবেই দমে যাবার পাত্র ছিলেন না। অকুতোভয় সাহস তাকে যে কোনো বিপদকে মোকাবেলার শক্তি দিয়েছিল বুঝি।
নবযুগ পত্রিকা বা যুগবাণী গ্রন্থে প্রকাশিত যে প্রবন্ধটি শাসক গোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি আপত্তি জানিয়েছিল, তা হচ্ছে ‘ডায়ারের ম্মৃতিস্তম্ভ’। লিখেছেন নজরুল, ‘….এই ডায়ারের মত দুর্দান্ত কশাই সেনানী যদি সেদিন আমাদিগকে এমন কুকুরের মত করিয়া না মারিত, তাহা হইলে কি আজিকার মত আমাদের এই হিম নিরেট প্রাণ অভিমানে ক্ষোভে গুমরিয়া উঠিতে পারিত-না, আমাদের আহত আত্মসম্মান এমন দলিত সর্পের মত গর্জিয়া উঠিতে পারিত? কখনই না। আজ আমাদের সত্যিকার শোচনীয় অবস্থা সাদা চোখে দেখিতে পারিয়াছি এই ডায়ারেরই জন্য।………. ডায়ারই আমাদের অন্ধত্ব ঘুচাইয়া দিয়াছে। অন্য প্রতারকদের মত গলায় পায়ে শৃঙ্খল পরাইয়া আদর দেখাইতে যায় নাই-সেই নারীর সামনে উলঙ্গ করিয়া মেথরের হাতে বেত্র দিয়া তোমার পিঠের চামড়া তুলিয়াছে। গর্দানে পাথর চাপা দিয়া বুুকের উপর হাঁটাইয়াছে, তাহাদের পায়ে তোমাদিগকে সিজদ বা সাষ্টাঙ্গ করাইয়া ছাড়িয়াছে। তোমাদিগকে জাগাইতে চাই এমনি প্রচন্ড নির্মম কশাই-শক্তি।” নজরুল এখানেই থেমে থাকেন নি । জালিনওয়ালাবাগের গণহত্যাকে কেউ সমর্থন করতে পারে নি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বৃটিশ সরকার প্রদত্ত ‘নাইট হুড’ খেতাব ফেরত দেন। নজরুল বুঝেছেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাতির চিত্তে যদি আঘাত হানা যায়, তবে তারা জেগে ওঠবে। পরাধীনতায় ন্যূব্জ জাতিকে জাগরণের স্বপ্নইতো তাকে দিয়ে গণজাগরণমূলক ও রাজদ্রোহী বিরোধী রচনা সৃষ্টিতে নিরত রেখেছে। তাই ডায়ার প্রসঙ্গ টেনে জনগণকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন, “ডায়ারের বুট এমন করিয়া তোমাদের কলিজা মথিত না করিয়া গেলে তোমাদের চেতনা হইত না। তোমাদের মুখের সামনে তোমাদের আত্মীয়-আত্মীয়ার মুখে এমনি করিয়া থুথু না দিলে তোমাদের মানবশক্তি ক্ষেপিয়া উঠিত না। তাই আজ আমরা ডায়ারকে প্রাণ ভরিয়া আশীর্বাদ করিতেছি, খোদা তোমার মঙ্গল করুন।….. নিশ্চয়ই তুলিব তোমার স্মৃতিস্তম্ভ, মহৎ প্রতিহিংসারূপে নয় , প্রতিদান স্বরূপে। আজ আমাদের এ মিলনের দিনে তোমাকে ভুলিতে পারিব না ভাই। এই মহামানবের সাগরতীরে ভারতবাসী জাগিয়াছে-বড় সুন্দর মোহন মূর্তিতে জাগিয়াছে। সেই তোমার আনন্দের হত্যার দিনে, সেই জালিয়ানওয়ালাবাগের হতভাগাদের রক্তের উপর দাঁড়াইয়া হিন্দু মুসলমান দুই ভাই গলাগলি করিয়া কাঁদিয়াছে। … কাঁদিয়ছি-গলা জড়াজড়ি করিয়া কাঁদিয়াছি-আমাদের ভাইদের খুন-মাখানো সমাধির উপর দাঁড়াইয়া আমরা এক ভাই অন্য ভাইকে চিনিয়াছি, আর বড় প্রাণ ভরিয়াই গাইয়াছি-‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।’ আজ এস ডায়ার, আমাদের এই মহামিলনের পবিত্র দৃশ্য দেখিয়া যাও।” তবে লেখাটি ছাপা হবার পর হাইকোর্টের জজ পত্রিকার প্রকাশক-পরিচালক ফজলুল হককে আবারো সতর্ক করে দেন। কিন্তু এদিকে পত্রিকার কাটতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। ফজলুল হক অবশ্য নজরুলকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘চুটিয়ে লেখো। বেটাদের টনক নাড়িয়ে দাও।’ শেরে বাংলার উৎসাহ নজরুলকে আরো বেশী উচ্চকিত করে । তার কলম আরো শানিত হয়ে ওঠে। নজরুল লিখলেন, ‘মুহাজিরিন হত্যার জন্য দায়ী কে?’ মুহাজির মানে নির্বাসিত। মুহাজিরিন মানে নির্বাসিতেরা। তার অর্থ নির্বাসিতদের হত্যার জন্য দায়ী কে? যুদ্ধ শেষে তুরস্কের হৃতরাজ্য ফিরিয়ে না দেওয়ার দারুণ ক্ষোভে দুঃখে একদল ভারতীয় মুসলমান ‘হিজরৎ’ বা স্বেচ্ছানির্বাসন বরণ করে চলে যাচ্ছিল আফগানিস্থানে। তারা ভারতবর্ষে থাকবে না, থাকবে না ব্রিটিশের রাজত্বে। দলে দলে যাচ্ছিল তারা সিন্ধু থেকে, সীমান্ত প্রদেশ থেকে। অভিমানী শোকার্তের শোভাযাত্রা। নিরস্ত্র, নিরুপদ্রব, নিঃসহায়। আফগানিস্তান বলে পাঠালো, আর লোক নেওয়া চলবে না । তখন ব্রিটিশ সরকার যাত্রীদের বাধা দিল। চলি­শ জনের একটা দল সে বাধা মানতে চাইল
না । যা অবশ্যম্ভাবী পরিণতি তাই হল। সামরিক পুলিশ গুলি করল। নিরীহ কতগুলি মানুষ যারা স্বদেশের স্বজনের মায়া মমতা ছেড়ে নির্যাতন থেকে নিস্কৃতির আশায় নির্বাসনে চলে যাচ্ছে, তাদের প্রতি একি বর্বর ব্যবহার। এ একেবারে চিরন্তন নিষ্কৃতি যেন।

>>>  তাঁর ফিরে আসায় আজ অনন্য বাংলাদেশ

নজরুলের মধ্যে এ ঘটনার প্রতিক্রিয়া হলো। লিখলেন তিনি,….. “কিন্তু আর আমরা দাঁড়াইয়া মার খাইব না, আঘাত খাইয়া অপমানে বেদনায় আমাদের রক্ত এইবার গরম হইয়া উঠিয়াছে। কেন, তোমাদের আত্মসম্মানজ্ঞান আছে, আমাদের নাই? আমরা কি মানুষ নই? তোমাদের একজনকে মারিলে আমাদের এক হাজার লোককে খুন কর, আর আমাদের হাজার লোককে পাঁঠা-কাটা করিয়া কাটিলেও তোমাদের কিছু বলিতে পারিব না?…. এই অত্যচারের; এই মিথ্যার বনিয়াদে খাড়া করা তোমাদের ঘর-মনে কর কি চিরদিন খাড়া থাকিবে? …..তোমাদের জুলুমে নিপীড়িত হইয়া মানবাত্মার এত পাশবিক অবমাননা সহ্য করিতে না পারিয়া মানুষের মত যাহারা স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিতে পারিল যে, এখানে আর ধর্ম-কর্ম চলিবে না, এবং চিরদিনের মত তোমাদের সংস্রব ছাড়িয়া সালাম করিয়া বিদায় লইল, সেই বিদায়ের দিনে তাহাদের হত্যা করিলে, আবার হত্যা করিলে আমাদেরই ভারতীয় সৈন্য দ্বারা। যাহাকে হত্যা করিলে তাহাকে হত্যা করিয়াও ছাড় নাই। তাহার লাশ তিনদিন ধরিয়া আটকাইয়া রাখিয়া পঁচাইয়া গলাইয়া ছড়িয়াছ। মৃতের প্রতিও এত আক্রোশ এত অসম্মান কেবল তোমাদের মত সভ্য জাতিই একা দেখাইতে পারিতেছে। তোমাদের কিচনার-লর্ড কিচনার মেহেদীর কবর হইতে অস্থি উত্তোলন করিয়া ঘোড়ার পায়ে বাঁধিয়া ঘোড়দৌড় করিয়াছ, তোমাদের এই সৈন্যদল যে তাহারই শিষ্য। না জানি আরো কত বাছাদের, আমাদের কত মা বোনদের খুলি উড়াইয়াছ, তোমরাই জান। আমাদের যে ভাই আজ তোমাদের হাতে শহীদ হইল সে এমন এক মুক্ত স্বাধীন দেশে গিয়ে পৌঁছিয়াছে যেখানে তোমাদের গুলি পৌঁছিতে পারবে না। সে যে মুক্তির সন্ধানেই বাহির হইয়াছিল। মনে রাখিও সে খোদার আরশের পায়া ধরিয়া ইহার দাদ (বিচার) মাগিতেছে। দাও উত্তর দাও। বল তোমার কি বলিবার আছে।” এই প্রতিবেদনের পরই নবযুগের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল। আর স্বাভাবিক কারণে এসব প্রবন্ধে সমৃদ্ধ যুগবাণী বাজেয়াপ্ত হবেই। যুগবাণীর প্রতিটি প্রবন্ধ বা নিবন্ধই ছিলেন উপনিবেশিক শাসকের শোষণ, শাসন, ত্রাসনের বিরুদ্ধে।
নজরুল গ্রন্থে মোট ২১টি রচনা সন্নিবেশিত করেন। উলি­খিত প্রবন্ধগুলো ছাড়াও রয়েছে ধর্মঘট, লোকমান্য তিলকের মৃত্যুতে বেদনাতুর কলিকাতার দৃশ্য, ছুঁৎমার্গ, উপেক্ষিত শক্তির উদ্বোধন, রোজ কেয়ামত বা প্রলয়দিন, বাঙালির ব্যবসাদারী, ভাব ও কাজ, আমাদের শক্তি স্থায়ী হয় না কেন, কালা আদমীকে গুলি মারা, শ্যাম রাখি না কূল রাখি, লাট প্রেমিক আলি ইমাম, জাতীয় শিক্ষা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও জাগরণী। এর মধ্যে ‘জাগরণী’ প্রবন্ধটি নবযুগের জন্য লেখা হলেও পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তা অন্য একটি কাগজে ছাপা হয়। গ্রন্থটি ২৬ অক্টোবর ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় আর নিষিদ্ধ হয় একই বছরের ২৩ নভেম্বর। ইতিমধ্যে গ্রন্থটির প্রায় সব কপিই বিক্রি হয়ে যায়। গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত হলেও নজরুল ছিলেন নির্বিকার। তিনি ততোদিনে ‘ধুমকেতু’ নামে আরেকটি পত্রিকা প্রকাশ করে সেখানেও তার কলম অব্যাহত রাখেন। একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি আর অন্যহাতে যে রণতূর্য নিয়ে জন্মেছিলেন তা তিনি কখনো ফেলে আসেন নি। নজরুল বলতেনও, ‘আমি সত্যরক্ষার, ন্যায় উদ্ধারের বিশ্ব প্রলয় বাহিনীর লাল সৈনিক। আর্তের অশ্রæমোচন আমার নয়, আমার রণতূর্য। আমি রুদ্রের, আমি করুণার নই, আমি সেবার নই, আমি যুদ্ধের, আমি সেবক নই, আমি সৈনিক। ” দুর্দিনের যাত্রী গ্রন্থে নজরুল একথা লিখেছিলেন। দুর্ভাগ্য, তার এই প্রবন্ধ গ্রন্থটিও বাজেয়াপ্ত হয় ১৯২৬ সালে প্রকাশের পর পরই। এই গ্রন্থে লিখেছিলেন নজরুল ‘আমি সৈনিক’ প্রবন্ধে-“রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, প্রফুল­ বাংলার দেবতা, তাদের পূজার জন্য বাংলার চোখের জল চির নিবেদিত থাকবে। কিন্তু সেনাপতি কই? সৈনিক কোথায়? কোথায় আঘাতের দেবতা, প্রলয়ের মহারুদ্র?” একই বছর প্রকাশিত নজরুলের তৃতীয় প্রবন্ধগ্রন্থ ‘রুদ্র মঙ্গল’ বাজেয়াপ্ত করা হয়। নজরুল নিজের সম্পাদিত ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ দিয়ে গ্রন্থটি নিজেই প্রকাশ করেছিলেন। ‘বিষবন্দী’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি উলে­খ করেছিলেন, “আমাদের কাছে প্রেম ভন্ডামি, করুণা বিদ্রæপ, প্রণয় কশাঘাত, প্রীতভীরুতা। আমাদের বিবাহের লাল চেলি দেশ শত্রæর আঘাতে রক্ত-রাঙা উত্তরীয়, ফাঁসির রশি আমাদের প্রিয়ার ভুজ বন্ধন।” নজরুলের এই রচনায়ও রাজদ্রোহিতার সামিল হিসাবে শাসকের কাছ গণ্য হয়েছিল। এই তিনটি প্রবন্ধ গ্রন্থের বাইরেও নজরুলের একটি প্রবন্ধ পুস্তিকা রয়েছে, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দি’। ৪ পৃষ্ঠার অগ্নিস্রাবী এই পুস্তিকায় নজরুল লিখেছেন, “আজ ভারত পরাধীন। তার অধিবাসীবৃন্দ দাস। এটা নির্জলা সত্য। কিন্তু দাসকে দাস বললে, অন্যায়কে অন্যায় বললে এ রাজত্বে তা হবে রাজদ্রোহ। এতো ন্যায়ের শাসন হতে পারে না। এই জোর করে সত্যকে মিথ্যা, অন্যায়কে ন্যায়, দিনকে রাত বলানো-একি সত্য সহ্য করতে পারে? এ শাসন কি চিরস্থায়ী হতে পারে।” ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারী প্রকাশিত এই পুস্তিকাটি অবশ্য বাজেয়াপ্ত করা হয়নি।
নজরুল তার প্রবন্ধ গ্রন্থে স্বাধীনতার জন্য ছিলেন সোচ্চার। পরাধীনতার বিরুদ্ধ তিনি তার শক্তিমত্তাতাতে প্রয়োগ করেছিলেন। নজরুল নিজেকে সর্বহারা শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে অবস্থান তৈরি করেছিলেন বলে তার হারাবার কিছু ছিল না। নজরুলের প্রবন্ধসমূহ মূলত তার সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব, কর্তব্য ও চেতনার প্রতিফলন। তাই জাতীয় শিক্ষা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি বিষয়েও তার চিন্তার প্রতিফলন দেখা যায় প্রবন্ধসমূহে।

নজরুলের সাংবাদিকতার জীবন দীর্ঘ  না হলেও ধুমকেতুর মতো এসে তিনি ধুমকেতুর মতোই আবার সরে গিয়েছেন।  স্বাধীনতার জন্য রাজনীতি করা যখন দ্বিধা দ্বন্ধে, তখন নজরুল একাই কলম ধরেছেন, গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন, বাজেয়াপ্তও হয়েছে। কিন্তু থেমে থাকেন নি। আর তা থাকেন নি বলে এখানো এই নব্বই বছর পরও এদেশে স্বাধীন ও সাহসী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রগুলো প্রসারিত রয়েছে। 

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

সর্বশেষ

এই বিভাগের সর্বশেষ

সর্বশেষ :