ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

সেই প্রথমবার আমি ভরপেট রুটি খেতে পেলাম, দ্রৌপদী মুর্মু

আনোয়ার সজীব- লেখক, সম্পাদক ও অর্থনীতিবিদ

আজ যা লিখছি, সেটি কেরালার মালাপ্পুরম জেলা’র একটি বিশেষ ঘটনা!  কালেক্টর শ্রীমতী রানী সোয়ামই, তিনি একদিন একদল কলেজ ছাত্রী’র সাথে মত বিনিময় করছিলেন। তাঁর হাতে সামান্য একটা ঘড়ি ছাড়া অন্য কোনো প্রসাধন-সামগ্রী ছিলো না । ছাত্রীরা তাঁকে দেখে আশ্চর্য্ হয়, কারন ওনার মুখে সামান্য ফেস পাউডারের স্পর্শ মাত্র ও নেই । [কথাবার্তা মূলত ইংরিজিতে হচ্ছিল]। তিনি মাত্র তিন-চার মিনিট এর মতো কথা বলেছেন । তাতেই যেন মনে হলো যে, প্রতিটি শব্দের মধ্যে দৃঢ় সংকল্পের সুস্পষ্ট আভাস।

[কথপোকথন হচ্ছিলো কালেক্টর ম্যাডাম আর ছাত্রীদের মধ্যে] –

– ম্যাডাম আপনার নাম?

– আমার ডাকনাম রানী আর সোয়ামই আমার পারিবারিক নাম। আমি ঝাড়খন্ড রাজ্যের বাসিন্দা আমি। আর কিছু জানতে চাও ?

[ভিড় ঠেলে একটি মেয়ে হাত তুলে দাঁড়ালো] জ্বি ম্যাডাম!

কালেক্টর ম্যাডাম – হ্যাঁ, বলো।

– ম্যাম, কিছু মনে করবেন না তো? একটা প্রশ্ন ছিলো আমার!

– হিম, নির্ভয়ে বলে ফ্যালো

– আপনি মেকআপ করেন না কেন, ম্যাডাম ?

প্রশ্ন শুনে কালেক্টর ম্যাডাম কিছুটা অস্বস্তি ই বোধ করলেন, ওনার মুখের হাসিটা ও উবে গেলো আর ছাত্রীরাও চুপ !

কালেক্টর ম্যাডাম সামনে রাখা বোতল থেকে কিছুটা জল খেয়ে মেয়েটিকে বসার ইঙ্গিত দিলেন । স্বল্পভাষী কালেক্টর ম্যাডাম বললেন,- ‘দেখ, তোমার প্রশ্নটা সত্যিই আমাকে বেশ মুশকিলে ফেলেছে। দু-এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, এর উত্তর পেতে তোমাদের আমার জীবনের কিছু স্মৃতি ভাগ করে নিতে হবে। সেজন্য তোমাদের ব্যস্ত সময় থেকে দশ মিনিটের মতো সময় আমাকে দিতে হবে । তোমরা কি দশ মিনিট ধৈর্য্য ধরে বসতে পারবে, অন্য মানুষের গল্প শুনতে?

— জ্বী ম্যাডাম, আমরা রাজি আছি, আপনি বলুন।[ মেয়েরা সমস্বরে বলে ওঠে ]।

– [আচ্ছা ঠিক আছে, শোনো তাহলে] ‘আমার জন্ম হয়েছিল ঝাড়খন্ড রাজ্যের এক আদিবাসী পরিবারে । কালেক্টর ম্যাডাম একবার তাঁর শ্রোতাদের মুখের পানে দৃষ্টি দেন। দেখেন সকলে আগ্রহ ভরে তাকিয়ে রয়েছে তাঁর দিকে ।

>>>  শিক্ষক, একটি জাতির রূপকার

– আমার জন্ম, কোডারমা জেলার এক প্রত্যন্ত আদিবাসী এলাকার একটা ছোট্ট ঝুপড়ির মধ্যে। চারপাশে মাইকা’র খনি । বাবা-মা সেখানেই কাজ করতেন। আমার চেয়ে বড়, দুই ভাই আর একটা ছোট বোন। আমরা সকলেই ঐ ছোট্ট ঝুপড়িটার মধ্যে থাকতাম। বর্ষায় ঝুপড়ির মধ্যে জল ঝরতো, শীতে ঝরতো শিশির। বাবা মা খুবই কম পয়সায় ঐ সব খাদানে কাজ করতেন, কারণ ওটা ছাড়া অন্য আর কোন কাজ তাঁরা জানতেন না । তবে কাজটা ছিল খুবই নোংরা।

– আমার যখন বছর চারেক বয়স, বাবা-মা, দুই ভাই, সকলেই কি এক অজানা অসুখে আক্রান্ত হয়ে বিছানা নিলেন। তখন তাঁরা নিজেরাও জানতেন না যে তাঁদের রোগের মূল কারণ হলো ঐ খাদানের বাতাসে মিশে থাকা মাইকা’র ধূলা । আমার বয়স ৫ বছর হতে না হতে এক ভাই মারা গেল, রোগে।

[দীর্ঘশ্বাস ফেলে কালেক্টর ম্যাডাম চুপ করে থাকেন। রুমাল দিয়ে চোখের জল মুছে নেন, পুরোনো স্মৃতি সত্যিই কষ্টদায়ী]!

– বেশিরভাগ দিনই, আমাদের খাবার বলতে জুটতো একটা কি দুটো রুটি আর ভরপেট জল। রোগে ভুগে একসময় দুই ভাইয়েরই মৃত্যু হলো। তোমরা বলবে ডাক্তার দেখানো উচিত ছিল, তাই নয় কি? আমাদের গ্রামে ডাক্তার তো দূরের কথা, একটা স্কুল পর্যন্ত ছিলো না। ছিলো না কোন হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র কিংবা শৌচাগার । বিদ্যুৎ তো ছিলোই না! তোমরা কল্পনা করতে পারো এমন একটা গ্রামের কথা?

– এর মধ্যেই একদিন বাবা হাড়-চামড়া-সার, অভুক্ত, আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন টিনের চাদর দিয়ে ঘেরা একটা অভ্র খাদানে। পুরোনো আর গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খাদানটা বেশ বদনামও কুড়িয়েছিলো। লাগাতার খুঁড়তে খুঁড়তে তখন খাদানটা অতলান্ত গভীর । মাটির নিচে শত-সহস্র ধারায় ছড়িয়ে পড়েছে তার গভীর গহ্বরের জাল । আমার কাজ ছিলো খনির ঐ ছোট ছোট গহ্বরের মধ্যে ঢুকে, সেখান থেকে অভ্রের আকরিক তুলে নিয়ে আসা। দশ বছরের কম বয়সী ছেলেমেয়েরাই পারে ঐরকম গভীর গর্ত থেকে অভ্রক তুলে আনতে। কাজের পর জীবনে সেই প্রথমবার আমি ভরপেট রুটি খেতে পেলাম । কিন্তু, অনভ্যস্ত পেটে সইলো না, আমার বমি হয়ে গেল।

>>>  আমি আপনাদের কাছে এসেছি

– যে বয়সে স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে পড়াশোনা করার কথা, সেই বয়সে অন্ধকার গুহার মধ্যে ঢুকে অভ্রক তুলে আনতে হতো আমাকে! বিষাক্ত ধূলোর মধ্যে, আবদ্ধ জায়গায় নিঃশ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছিলাম তখন। কতবার অভ্রকের খনি ধ্বসে পড়েছে, ভেতরে বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা আটকা পড়ে মারা গেছে। না হলে দুরারোগ্য ব্যাধির কামড়ে মারা গেছে । সেটাই ছিলো তাদের নিয়তি।

– দিনে আট ঘণ্টা কঠিন পরিশ্রম করার পর একবেলা কোনো রকমে খাবার জোটানোর মতো পয়সা পাওয়া যেত। নিত্য দিনের ক্ষুধা-তৃষ্ণা আর বিষাক্ত ধূলোর মধ্যে শ্বাস নেওয়ার কারণে আমি ধীরে ধীরে অসুস্থ আর নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলাম। ঘুরতে না ঘুরতে আমার ছোট বোনটাও এসে লেগে যায়, খাদানের কাজে । বাবার শরীর একটু জুৎ হতেই তিনিও জুটে যান খাদানের কাজে। এখন সকলে মিলে একসাথে কাজ করার ফলে কাউকেই না খেয়ে থাকতে হয়না।

– তবে ভাগ্যের লিখন, কে করবে খন্ডন? সেবার আমার ধূম জ্বর। আমাকে ঘরে রেখে মা বাবা বোন সকলেই গেছে কাজে। আচমকা মুষলধারে বৃষ্টি নামে সেদিন। খনির ভেতরে শ্রমিকরা কাজ করছিলো। জলের তোড়ে খনিতে ধ্বস নামার ফলে হাজার হাজার শ্রমিক চাপা পড়ে মারা যায়! তাদের মধ্যে আমার মা-বাবা-বোন সকলেই ছিলো। আমি পরিবারহারা হলাম, চিরতরে!

[কালেক্টর ম্যাডামের দুই চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে । শ্রোতারা বাক্যহারা। অনেকেরই চোখে জল]।

– মনে রাখতে হবে আমি তখন মাত্র ছ’বছরের শিশু। শেষমেষ আমি গিয়ে পৌঁছাই সরকারি অগাতি মন্দিরে।  সেখানেই আমার শিক্ষা জীবনের সূচনা। যদিও আমার গ্রামেই আমার অক্ষর জ্ঞান হয়েছিলো, তবে তা নামমাত্র। আর আজ সেই অভ্রক খাদানের পরিবার-পরিজনহীন মেয়েটাই এখানে তোমাদের সামনে কালেক্টর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

– বুঝতে পারছি, এখন তোমরা ভাবছো আমার জীবনের এই অতীতের সাথে মেকআপ ব্যবহার না করার কি সম্পর্ক থাকতে পারে, তাই তো ?

>>>  অগ্নিসন্ত্রাস,অস্থিতিশীল পরিবেশই কি টেক ব্যাক

– পরবর্তী সময়ে শিক্ষা গ্রহণের কালখন্ডে আমি জানতে পারি যে, ছোটবেলায় সেই বিপজ্জনক ছোট ছোট অন্ধকার গুহার ভেতরে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে যে অভ্রক আমি তুলে আনতাম সেগুলো আসলে মেকআপ সামগ্রী তৈরীর কাজে লাগে। [অভ্রক মূলত মুক্তর মতো একটা খনিজ সিলিকেট। বড়ো বড়ো প্রসাধনী বস্তু প্রস্তুতকারী দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলো তাদের প্রোডাক্টের মধ্যে চামড়ায় একটা চমকদার জেল্লা বা ‘গ্লেজ্’ ফুটিয়ে তোলার জন্য মিশিয়ে থাকে। কসমেটিকস্ কোম্পানিগুলোর ভাঁড়ারে নিয়মিত অভ্রকের যোগান দেয় ঐ আমার মতোই ২০,০০০ ছোট-ছোট, বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়ে। গোলাপ কোমল সেই শিশুদের ফুলের মতো জীবনের রক্ত-মাংস পাথরে থেঁতলে তবেই না অভ্রক মানুষের গালের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করে‌! আজও আমাদের চামড়ার সুন্দরতা বাড়ানোর জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য থেকে বঞ্চিত ছোট ছোট বাচ্চাদের হাত দিয়ে তুলে আনা লক্ষ লক্ষ টাকার অভ্রকের ব্যবহার কসমেটিকস্ কম্পানিগুলো করে চলেছে]।

– আমার যা বলার ছিল তোমরা শুনলে । এবার বলো তো আমি কি করে সৌন্দর্য্য বর্ধনে প্রসাধনী ব্যাবহার করি? বাবা-মা-ভাই-বোন সকলকেই অভ্রকের খনি গ্রাস করে নিলো, যে মায়ের গায়ে কোনোদিন ছেঁড়া কাপড় ছাড়া অন্য কিছু দেখলাম না, তাঁর স্মৃতি মাথায় নিয়ে আমি কি করে রেশমী শাড়ি পড়ে ঘুরি ? বলো তোমরা।

কালেক্টর ম্যাডাম (রানী সোয়ামই) নিজের কাজে চলে গেলেন । কিন্তু কলেজের ছাত্রীরা থো হয়ে বেশ কিছু সময় সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর তারাও নিজেদের কাজে বেরিয়ে পড়লো।

[আজও ঝাড়খন্ডের উচ্চ গুণমান সমৃদ্ধ অভ্রকের খনি থেকে হাজার হাজার শিশু, স্কুলে না গিয়ে অভ্রক তোলার কাজে লেগে আছে। তারা হয় রোগে ভুগে, নয়তো না খেতে পেয়ে, অপুষ্টিতে অথবা ভূ-স্খলনে মাটি চাপা পড়ে মারা যায়]।

এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে । দিন মাস বছর ঘুরেছে । সেই কালেক্টর ম্যাডাম এখন ভারত গণরাজ্যের প্রথম নাগরিক । মহামহিম রাষ্ট্রপতি, শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মু।

(কাহিনী: সংগৃহীত)

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

সর্বশেষ

এই বিভাগের সর্বশেষ

সর্বশেষ :