শিকল…
আনোয়ার সজীব
স্নিগ্ধ নীলাম্বর, কী অদ্ভূত তার রং আর রূপের খেলা! কখনো সাদা-কালো, কখনো আবার ধূসর। ভোরের আকাশ কাঁচা হলুদের মতো হালকা রঙের, গোধূলির আকাশ রক্তিম সূর্যের বিচ্ছুরিত আলোক রশ্মির মতো লালচে, আবার রাতের আকাশ চাঁদ-তারা’দের আহ্বানে সাড়া জাগানো এক অবাক ছবির ফ্রেম। কিন্তু কোনো রঙ-ই যে আকাশের নয়, তাইতো আকাশ বহুরূপী!
মানুষের মনও আকাশের সাথে মিলে যায় অনেকাংশে; কখন যে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো আবেগে জড়িয়ে পড়ে, আর তার আগ্রাসনে শাসিত হয়- সেই রূপটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে একমাত্র আচরণের মাধ্যমে, আচরণ ই বলে দেয় অন্তরের ভাষা। সেই ভাষায় যখন আবেদনের মিশেল ঘটে, তখনই ছায়া পড়ে যৌবনের। যৌবনের বয়ে চলা আঁকা-বাঁকা বন্ধুর পথ ধরে, অথচ এই পথেই হাঁটতে হয় জীবনের এক কঠিন অধ্যায় কে! ঠিক তেমনি ভাবেই সে-পথ ধরে হেঁটে গিয়েছে, পাড়াগাঁয়ের এক সাদাসিদে বালিকা।
কিছুদিন আগেও তার শরীরে ছিলো উষ্ণহীনতা’র ছাপ, যৌবন তাকে আলতোভাবে ছুঁয়ে গেছে বহুদূর। চাহিদার তাড়নায় সে ও ছটফট করছে, প্রকৃতি তাকে বুকে ওড়না জড়াতে শিখিয়েছে, আর জানিয়েছে পত্র পতনের পর বৃক্ষের শাখায়-শাখায় কঁচি পাতাদের যে আগমন ঘটে- তারই নাম বসন্ত! মুখবন্ধ করে ভেসে ওঠা বুকফাটা চিৎকার, ব্যাপনের মতো ফাগুন হাওয়ায় ছড়িয়েছে দিকে দিকে। তবু লজ্জা তাকে আঁটকে রেখেছে চার দেয়ালের আড়ালে।
শ্যাম বর্ণের মসৃণ জোড়া ভ্রু’র নিচে হরিণীর দু’টি চোখ, যার চোখে একবার সেই তীক্ষ্ণ চাহুনির দৃপ্ত রশ্মি গিয়ে পড়েছে, সে-ই মাতোয়ারা হয়েছে রঙ্গিন ভুবনে, নেশার এক মায়াবী খেলায়।
বয়স বারো কি তেরো হবে তার। দেহের গড়নের সাথে বয়সের ঠিকঠাক মিল করাটা বেশ কঠিন, যেন ডিম আগে নাকি মুরগী আগে’র মতো বিষয়? প্রথম দেখে যে কেউই বলবে যে, সে ষোড়শী।
প্রকৃতি’র অলঙ্কারে সে প্রতিনিয়ত সাজে; গলায় বকুল ফুলের চাকি, হাতে শিউলি’র মালা, খোঁপায় গাদা, আর বেনির সাথে পেঁচিয়ে হিজলের ফুল পরে সাজা যেন তার নিত্যদিনের রুটিনের মধ্যে পড়ে থাকে। গোলাপের লাল টুকটুকে পাপড়ি গোল করে টিপ বানিয়ে পরে ও, চোখে কাজল এঁকে কানে গুজে দেয় রক্তজবা। আর ঠোঁট লাল করে সাজায়, পাতলা রঙিন কাগজ থু-থু দিয়ে ঠোঁটে লাগিয়ে।
প্রকৃতির লজ্জার সাথে মিলে যায় ওর নাম, লাজুকলতা। কিন্তু ছোটবেলা থেকে লতা ডাকে-ই ওর বেড়ে ওঠা। চোখমুখ জুড়ে লজ্জার ছাপ থাকলেও মনে ছিলো দারুণ চঞ্চলতা। আর সেই জোরেই যায়গা করে নিয়েছিলো পাড়াগাঁয়ের এক তরুণ যুবকের মনে, যে তার ছোটবেলার খেলার সাথী ছিলো। নারকেল পাতার বাঁশি বানিয়ে খুব ভালো বাজায় ছেলেটি! ওর নাম সবুজ। কিছুদিন আগেও ওরা একসাথে শাপলা তোলা, ঘাসফড়িং ধরা, পদ্মফুল তুলে আনা, মাছ ধরা, ঘুড়ি উড়ানো, পুতুলের বিয়ে দেওয়া সহ আরও কতো খেলা খেলেছে। কিন্তু এখন আর তা হয় না! কিসের যেন একটা অদৃশ্য বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে গেছে লতা। ইচ্ছে হলেই আর পাখির মতো ডানা ঝাপটে উড়তে পারে না মুক্ত আকাশে। সবুজ ও আর আগের মতো নারকেল পাতার বাঁশি বাজায় না। অব্যক্ত কী একটা কথা যেন সবুজের মাথায় ঘুরপাক খায়, আর তাকে ভাবায় সারাক্ষণ। কতোবার বলতে গিয়েও বলতে পারেনি, বোঝাতে পারেনি না বলা কথাটি! যখন বলার ছিলো কিন্তু সময় হয়ে ওঠেনি, কিন্তু এখন সময় হয়েছে ঠিকই কিন্তু সুযোগ হয় না।
অনেক দিন পর, আজ লতা আবার আগের মতো খুব করে সেজেছে, কলসি নিয়ে সখীদের সাথে নদীর ঘাটে জল আনতে যাবে বলে। সবুজ ও আড়ালে আড়ালে চুপিসারে পিছু নিয়েছে। কিন্তু সুযোগ হলো না আজও মনের অব্যক্ত কথাটি প্রকাশ করার। ওরা চার সই মিলে দলবেঁধে হেঁটে যাচ্ছিলো আর খেয়াল রাখছিলো, যাতে খুব পিছনে যেন কেউ না পড়ে কিংবা বেশি আগেও যেন কেউ না চলে যায়। এমন সময় ওদের পাশ দিয়ে সাং করে একটা ট্যাক্সি চলে গেলো। ওরা চমকে উঠলো সবাই। কিছুটা সামনে গিয়ে আবার পিছন দিকে এলো ট্যাক্সিটা, থামলো ঠিক ওদের পাশ ঘেঁসে। ট্যাক্সির ভিতর থেকে মুখ বের করে কালো চশমা পরা একজন আধ-বয়সী লোক লতার দিকে তাকালো। লোকটির পাশে আরো তিন-চার জন লোক বসেছিলো। ভাবসাব দেখে মনে হলো কালো চশমা পরা লোকটি বিদেশ থেকে এসেছে, হয়তো সৌদিআরব, কাতার অথবা কুয়েত থেকে। তখন ওরা সবাই আরও তড়িঘড়ি করে হাঁটতে শুরু করলো।
দুইদিন পর!
লতা বারান্দায় বসে হাতে মেহেদী পাতার বাটনা দিয়ে আলপনা আঁকছিলো। এমন সময় সাদা দাঁড়ি ওয়ালা একজন লোক (মাথায় লম্বা টুপি, বগলে কালো ছাতা, গলায় লাল-সাদা রঙের পাগড়ি, সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি ওয়ালা) এসে লতাদের বাড়িতে প্রবেশ করলো। মুখভর্তি পানের চিবি দিয়ে জাবর কাটতে কাটতে বললো: দপ্তরি সাব কী বাড়িতে আছেন?
রমজান দপ্তরি আগন্তুক লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললো: আরে মানছু ঘটক যে! তো কি মনে কইরা এই সাতসকালে, গরীবের বাড়িতে?
পাগড়ি দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মানছু ঘটক বারান্দায় উঠে এলো, রমজান আলী তার বসার টুল খানা ঠেলে দিলো ঘটকের দিকে, সে-ও আরাম করে বসে পড়লো।
ঘটকের আগমনের উদ্দেশ্য রমজান আলী ঠাওর করতে পারে, কারণ আগেও দু’একজন এভাবেই আচমকা চলে এসেছিলো তার বাড়িতে। তাই সে-ও আগে থেকেই ঘরে চিড়া-মুড়ি-গুড় কিনে রেখেছে, কেননা যখন তখন আবার যে কেউ চলে আসতে ই পারে। কারণ, কন্যা যে তার বসন্তে পৌঁছে গেছে।
প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে আলাপ-আলোচনা হলো তাদের মধ্যে। আর সেই আলাপচারিতার বিষয় নিয়েই রাতে মুরব্বিদের বৈঠক বসলো ‘উঠোনে।
অধিকাংশ লোকজন গোলপাতার মাদুর বিছিয়ে বসেছে, আর মুরব্বিরা বসেছে চকি পেতে। মোল্লা বাড়িতে এমন গোল বৈঠক সচরাচর বসে না, কেবল কারো বিয়ে অথবা বড় কোনো ঝুট-ঝামেলা উপলক্ষে ই এমন বৈঠক বসে থাকে। এবার রমজান আলী লতার বিয়ের সম্মন্ধের বিষয়টি মুরব্বিদের খুলে বললো। ছেলে তাদের গ্রামেরই, উত্তর পাড়ার আফজাল খাঁ’র ছেলে ফিরোজ খাঁ। ফিরোজ ওমান থেকে ছয় মাসের ছুটিতে বাড়িতে এসেছে, মূলত বিয়ে উপলক্ষে-ই এসেছে ও। দীর্ঘ এগারো বছর পর সে দেশে এসেছে, যখন সে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলো তখন পাসপোর্ট অনুযায়ী ও’র বয়স ছিলো ছাব্বিশ বছর। প্রসঙ্গত কারণেই বয়সটা বেড়ে গিয়েছে বেশ, কিন্তু ব্যাপারটা ঐ যে! অর্থ-সম্পদ আর প্রতিপত্তির ভারে বয়সের অসামঞ্জস্যতা আর থাকে না পুরুষের। যার কারণে-ই বলী দিতে হয় অবলা মেয়েদের তুচ্ছ জীবন।
লতার বাপের মুখ থেকে খবর টা শুনে প্রথম প্রথম অনেকেই অমত পোষণ করলো। রাঙ্গা বুড়ি বললো : ইরাম ঢ্যার বয়সের পোলার লগে দুধের মাইয়াডার বিয়ে দেওন ভালা হইবো না। অহনও ভালা-মন্দ বুঝনের বয়স অয় নাই মাইয়াডার।
বিভিন্ন জনের ভিন্ন ভিন্ন মতামত শুনে রমজান রেগে গিয়ে বললো: হ হ বুঝবার পারছি, তোমরা হগ্গলে মিলা আমার কেমন ভালা চাইতাছো, হগ্গলেই চাও যেন ইরাম ভালা কুটুম যেন আমার না অয়!
কথাগুলো বলতে বলতে রমজান আলী যখন বৈঠক ছেড়ে উঠে যাচ্ছিলো, তখন আকসার আলী (মেম্বর সাব) রমজান কে উদ্দেশ্য করে বললো: আহা আহা, রমজান করতাসো কি? বহো মিয়া, আমি দুইডা কথা কই, হুইনা যাও।
[রমজান আলী আবার বসে পড়লো]
মেম্বর সাব: তোমার মাইয়ার ডিশিশোন তোমারই লইতে অইবো, আমরা মিয়া কইলে ই বা কী, আর না কইলে ই কী? তারপরেও মাইয়াডার বয়স তো মনে অয় পোলার আদা-আদি ও ওইবো না। তোমার মিয়া বাপ-মা বাঁইচা নাই, তাই কই কী- তোমার শ্বশুর-শাশুড়ির লগে একবার আলাপ সাইরা নিও।
[রমজান মাথা নেড়ে সায় দিলো]
সবাই বুদ হয়ে কথা শুনছিলো, সবুজও ছিলো তাদের মধ্যে! অধীর আগ্রহে সে-ও শুনছিলো লতার বিয়ের কথা।
মেম্বর সাব পান মুখে দিয়ে আবার বলতে শুরু করলো: ওউত-মোউত-বিয়ে এগুলা ওইলো উপর ওয়ালা’র হাত দিয়ে, দুনিয়াশুদ্ধ না কইরাও আল্লাহ চাইলে কেউ আটকাইতে পারবো না। হুদাহুদি ঠেনশোন কইরা পেরেশান হওনের দরকার নাই।
মজলিস ভেঙ্গে গেলো, কিন্তু সবুজ বসেই রইলো। মাথায় হাত দিয়ে কী যেন এক গভীর চিন্তায় মগ্ন সে! হয়তো ভাবছিলো: আহারে, আইজকা যদি আমিও ওমান থেইকা আইতে পারতাম, তাইলে…?
বেশ ধুমধামের সাথে একদিন বিয়ে হয়ে গেল লতার। যে বয়সে কথা ছিলো কোনো এক নতুন বউয়ের বাসরের মালা গেঁথে সালামি বুঝে নেওয়ার, অথচ সেই সালামি আজ তাকেই দিতে হলো। মধ্যরাত পর্যন্ত শত-শত মানুষের আনাগোনা ছিলো, সারাদিন ঠিকমতো খাওয়া ও হয়নি লতার। তাই নিস্তেজ শরীর নিয়ে কাচুমাচু হয়ে এককোনায় শুয়ে রইলো সে।
ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো এক গাদা পুঁচকে-পুঁচকির চেঁচামেচি তে, কিন্তু উঠে বসার মতো শক্তিটুকুও নেই তার। তবুও পা টেনেটুনে উঠতে হলো তাকে, গোসল সেরে এসে প্রতিমার মতো বসতে হলো একধ্যানে, আর ওভাবেই কাটলো দুইদিন। আসপাশের প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন সহ বিভিন্ন লোকজন আসছে আর সুবিধেমতো খোঁচা মেরে দু’কথা শুনিয়ে যাচ্ছে। কিছু করার নেই, বলারও নেই। তাই চুপচাপ শুনে ও সয়ে যাওয়াটাই বোধহয় নতুন বউয়ের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে থাকে, সেটা মনে করেই স্ট্যাচু হয়ে রইলো লতা। পরদিন বিকেলে শ্বশুর বাড়িতে নাইওর গেলো নতুন জামাই, সাথে গেলো আরো ছয়-সাত জন। সাথে পল্লবীও গেলো, পল্লবী হলো লতার ননদ।
বিয়ের নতুনত্বের রেশ কাটতে না কাটতেই ফিরোজের ছুটি শেষ হয়ে গেলো। হাতের মেহেদীর রং টাও ঠিক মতো উঠে নি এখনো। আজ রাতে ফিরোজের ফ্লাইট! সবাই অশ্রুসিক্ত চোখে বিদায় জানালো ফিরোজ কে। ফিরোজ যাবার সময় লতাকে পাঁচ’শ টাকার কয়েকটা নোট হাতের মধ্যে পুরে দিয়ে বললো: এবারের মতো আমার ছুটি শেষ, খুব শীঘ্রই আবার ফিরবো। ঠিকমতো খেয়াল রেখো সকলের, নিজের যত্ন নিও, আসি…!
কারো মুখে কোনো কথা নেই, আছে শুধু হাউমাউ কান্নার আওয়াজ। ফিরোজ পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছতে মুছতে ট্যাক্সিতে উঠলো। ট্যাক্সিটা সাং করে একটানে চোখের পলকে উধাও হয়ে গেলো!
ফিরোজ চলে যাওয়ার পর কয়েকদিনের জন্য বাপের বাড়িতে যায় লতা। এখন আর ওর মধ্যে আগের মতো চঞ্চলতা দেখা যায় না। আগের চাইতে ইদানীং কিছুটা নির্লিপ্ততা পরিলক্ষিত হয় ওর মধ্যে। আচরণের সাথে সাথে দৈহিক গড়নেরও বেশ পরিবর্তন হয়েছে লতার। বিয়ের আগের জামাকাপড়গুলো এখন আর ঠিকমতো গায়ে লাগে না। কয়েকদিন পর শ্বশুর বাড়ি থেকে লোক এসে নিয়ে যায় ও-কে। সেখানেও ওর মন মানতে চায় না। কখনও খিড়কির সাথে মাথা ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, আবার কখনো তাকিয়ে থাকে বাতায়নের ফাঁক দিয়ে। মাঝেমধ্যে জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে দ্যাখে সেই পথ, যে পথ ধরে ও এসেছিলো এই বাড়িতে। আবার যে পথ দিয়েই চলে গেছে সেই মানুষটি, যাকে ঘিরে স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছিলো ও। ধীরে ধীরে বিষাক্ত হয়ে ওঠে ওর চারপাশের বায়ুমন্ডল। আর এক মুহুর্তের জন্যেও মন মানতে চাইছে না এখানে। আবার ছুটে যায় বাপের বাড়ি।
রাতে ঘুম আসে না লতার, সারারাত এপাশ-ওপাশ করে আর কী যেন ভাবে ও। আবছা-আবছা স্বপ্নে হেঁটে যায় বহুদূর, কিন্তু ফিরে আসার মুহূর্তেই চমকে ওঠে ও, সারা শরীর ঘেমে যায়! বিছানা থেকে উঠে টেবিলের পাশে থাকা চেয়ারটায় বসে। কলমের খাপ ছাড়িয়ে খাতা ভরে কি যেন লেখে, তারপর তা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে ফেলে দেয়। আবার লেখে, তারপর আবারও তা ছিঁড়ে ফেলে দেয়।
মাঝরাত!
কোত্থেকে যেন একটা চিকন সুর ভেসে আসছে, মনে হয় ধারেকাছে কোথাও হবে? অতিপরিচিত, মধুর আর করুণ সুর! খুব চেনা চেনা লাগছে, বোধহয় কেউ নারকেল পাতার বাঁশি বাজাচ্ছে। মন আর মানতে চাচ্ছে না ওর, একমুহূর্তের জন্যে ও থাকতে চাইছে না এই আবদ্ধ খাঁচায়। জানালার পর্দা তুলে বাইরে তাকালো লতা। ঝিরিঝিরি মৃদু বাতাস এসে ওর বুক ছুঁয়ে দিলো, শিহরণে নেচে উঠলো অস্থির মন, ময়ূরীর মতো পেখম মেললো সারা শরীর জুড়ে। তারপর সে একদৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। ভরা পূর্ণিমা’র ঝলসানো জোছনায় তার তেজ কটালের টইটম্বুর যৌবন, যেন ভূ-অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা টেকটোনিক প্লেট-ও সরিয়ে দিচ্ছে, ছুঁয়ে দিলেই আট মাত্রার ভূমিকম্পে ধ্বসে পড়বে গোটা বিশ্বলোক! যেকোনো রাজা-ও রাজ্য ছেড়ে দিতে দ্বিধা বোধ করবে না এমন রূপ দেখে, অন্তত একমুহূর্তের জন্য নৈকট্য লাভের বাসনায়।
লতা ছুটে যেতে চায় বাঁশির সেই করুণ সুরের টানে। তাই সে দৌড়ায় আর ঝুমঝুম করে কী যেন বাজে, তখন সে থমকে দাঁড়ায়। তারপর আবার দৌড়ায়, আবার ঝুমঝুম করে বাজে, আবারও থমকে দাঁড়ায় সে। এভাবে এক পা বাড়ায়, একপায়ে শব্দ হয়! তারপর আরেক পা বাড়ায়, সে পায়ে ও শব্দ হয়। তখন আর পা চলে না ওর, খুব জোর দেয় পায়ে, তবুও চলে না। তখন সে হেঁচকা টান দেয়, সাথে সাথে দু’পা বেয়ে রক্ত নেমে আসে। রক্তের লোহিত কণিকা গলো তাকে মনে করিয়ে দেয়, ‘কে যেন তার পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে দিয়ে গেছে!’