ঢাকা, সোমবার, ১লা ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

যুক্তরাষ্ট্রকে বিদায় জানিয়ে চীনকে

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষীয়মাণ প্রভাব পুনরুদ্ধারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তিন দিনের সফরে সৌদি আরব এসেছেন। কিন্তু সৌদি আরব এবং উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে ‘কৌশলগত সহযোগিতার’ সম্পর্ক উন্নয়ন হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক কঠিন একটি কাজ।

গত বছরের জুলাই মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত গালফ কো–অপারেশন কাউন্সিলের সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল এটা প্রমাণ করা যে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে চলে যাবে না ও শূন্যস্থানটা চীন, রাশিয়া অথবা ইরানকে দিয়ে পূর্ণ করতে দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু অবিকল সেটাই ঘটে চলেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির পরও গত বছর দেশটির মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের মিত্রদেশগুলো হাইব্রিড দেশগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়েছে। বেইজিং এবং তেহরানের সাথে তারা সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে ও মস্কোর সাথে জোরালো মৈত্রী বজায় রেখেই চলেছে।

বাইডেন প্রশাসন যদিও প্রকাশ্যে চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার চুক্তিকে গুরুত্বহীন বিষয় বলেই অভিহিত করেছে। কিন্তু তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় অঞ্চল এবং বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন অনেকটাই উন্মত্তের মতোই আচরণ করে চলছে।

গত দুই দশকে যুক্তরাষ্ট্র তেল এবং গ্যাসের উৎপাদন বাড়িয়েছে, দৃশ্যত এখন তারা জ্বালানির ক্ষেত্রেই স্বনির্ভর। যুক্তরাষ্ট্রের এখন আর উপসাগরীয় দেশগুলোর তেল তেমনটা প্রয়োজন নেই। কিন্তু ওই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ তারা বজায় রাখতে চায়, যেন সংঘাত বেধে গেলে চীনে তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া যায় ও মিত্রদেশগুলোর জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়।

গত মাসে ব্লিঙ্কেন এই সতর্কবার্তা দিয়ে থাকেন যে ‘আজকের দিনে চীন আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।’ কিন্তু উপসাগরীয় অঞ্চলের স্বৈরশাসকদের কাছে বেইজিংয়ের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ওয়াশিংটনের গণতন্ত্রের চেয়ে বেশি ভালো এবং মানানসই বলেই মনে হচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার প্রভাবও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়ার সাথে মধ্যপ্রাচ্যের সম্পর্কে অস্পষ্টতা এমনকি জটিলতা রয়েছে। বাইডেন প্রশাসন এখন মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে ও পরিষ্কার বার্তা দিতে চাইছে যে তাদের ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করে দিয়েছে, ওই অঞ্চলের দেশগুলো রাশিয়াকে তাদের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা এড়াতে সহযোগিতা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পক্ষ ত্যাগ করুক নাহলে যুক্তরাষ্ট্র অথবা জি–৭ দেশগুলোর কঠোর রোষের মুখেই পড়তে হবে।

>>>  শক্তিশালী ভূমিকম্পে কাঁপল একুয়েডর, অন্তত ১৪ মৃত্যু

রাশিয়াকে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম কমাতে তেলের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সৌদি আরবকে বারবার অনুরোধ করেই চলছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সেই অনুরোধও উপেক্ষা করে চলেছে সৌদি আরব। মস্কোর সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছে সৌদি আরব। সৌদি আরবের যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের ওয়াশিংটনকে ‘মধ্য আঙ্গুল’ দেখিয়ে চলার নীতি ওই অঞ্চলে তাকে তুমুল জনপ্রিয় করে তুলেছে।

গত বছর রিয়াদকে ঔদ্ধত্যের জন্য শাস্তি দেওয়ার হুমকি দেন বাইডেন। এর প্রতিক্রিয়ায় সৌদি আরব চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও চীন–জিসিসি (গালফ কো–অপারেশন কাউন্সিল) ও চীন–আরব সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানান। চীনের পৃষ্ঠপোষকতায় সৌদি আরব এরপর ইরানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। এ ছাড়া সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক মেরামত করে সৌদি আরব। এসব কিছুই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য স্পষ্ট তিরস্কার।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সৌদি আরবের এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা এখন আঞ্চলিক প্রবণতা। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক মিত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতও চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করছে। ফ্রান্সের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক উন্নয়ন করেছে। ইরান, রাশিয়া ও ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করছে।

সামগ্রিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য তাদের বৈশ্বিক সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনছে। এটা আপাতভাবে বাণিজ্যিক কারণে। ২০০০ সালে যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে চীনের বাণিজ্য ছিল ১৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, ২০২১ সালে এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ২৮৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য ৬৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৯৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসরসহ মধ্যপ্রাচ্যের ছয়টি দেশ সম্প্রতি চীনের নেতৃত্বে পরিচালিত ব্রিকসে যুক্ত হওয়ার আবেদন করেছে। রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও ব্রিকসের সদস্য। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা যখন আরও কঠোর হচ্ছে, সেই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো ব্রিকসের সাথে যুক্ত হতে চাইছে।

এটা সত্যি যে তিন দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত ক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য ছিল। এখনো তারা সেটা বজায় রেখেছে। প্রশ্ন হলো, আগামী তিন দশকে সেটাই অব্যাহত থাকবে কি না?

>>>  ৭ জানুয়ারির নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠু ছিল না: যুক্তরাষ্ট্র

মধ্যপ্রাচ্য এমন একটি অঞ্চল, যেখানে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালু রয়েছে, আর সে ব্যাপারে সাধারণ মানুষের খুব বেশি যায় আসে না। আমেরিকাকে না বলা সেখানে খুবই জনপ্রিয় একটা অবস্থান। কেননা তারা মনে করে, আমেরিকা হচ্ছে একটি ভণ্ড ধরনের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, যারা কেবল মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র নিয়ে বুলি কপচায় সবসময়।

ওই অঞ্চলের মানুষেরা টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং তাঁদের নিজেদের চোখে দেখেছে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্র কী অপরাধটাই করেছে। তাঁরা দেখেছেন আফগানিস্তানে কী রকম পর্যুদস্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এই কারণে তারা যুক্তরাষ্ট্রকে সভ্যতার অভিভাবক কিংবা অপরাজেয় শক্তি বলে মনে করে না। ৯/১১–এর হামলার পর মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের গত ২০ বছরের আগ্রাসনের লাভ ও ক্ষতির খতিয়ান যদি নেওয়া যায়, তাহলে সেটা মোটেও তাদের পক্ষে যাবে না।



সংবাদটি শেয়ার করুন

এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ

ফেসবুকে যুক্ত থাকুন

সর্বশেষ

এই বিভাগের সর্বশেষ

সর্বশেষ :