এক যুগ আগে দেশের মোট পণ্য রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের হিসাব ছিল ৭৮ শতাংশ। গত বছর সেটি বেড়ে ৮২ শতাংশে উঠেছে। অন্যদিকে পাট এবং পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল ও হিমায়িত খাদ্যের হিস্যা কমেছে। আবার পাট এবং পাটজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি হিস্যা বাড়লেও তা খুবই সামান্য।
তৈরি পোশাকের পর পাট এবং পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্রকৌশল পণ্য এবং হিমায়িত খাদ্য—এগুলোই বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানির খাত। সুতরাং ওপরের পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, রপ্তানি বাড়লেও পণ্য বহুমুখীকরণ কচ্ছপ গতিতেই এগোচ্ছে। আর পুরো রপ্তানি খাতই দিন দিন তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল হয়েই পড়ছে। তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়লে দেশের সামগ্রিক রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় থাকে। তা না হলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের শীর্ষ এই উৎস ঝুঁকিতেই পড়ে যাচ্ছে।
এমন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে মধ্যম আয়ের তথা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হবে ২০২৬ সালে। এখন বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ পণ্য কোনো না কোনোভাবে অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধার আওতায় রপ্তানি করা হয়। এলডিসি থেকে উত্তরণ হলে এই অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা ক্রমান্বয়েই হারাতে থাকবে বাংলাদেশ। ২০২৯ সালের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা জিএসপি সুবিধা আর থাকবে না। তাতে পণ্য রপ্তানি, বিশেষ করে তৈরি পোশাকের রপ্তানিই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার রপ্তানি নীতি ২০২১-২৪–এ অন্য অনেক বিষয়ের পাশাপাশি রপ্তানি বহুমুখীকরণেও জোর দিয়েছে। এতে ১৪টি খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে অধিক মূল্য সংযোজিত তৈরি পোশাক, কৃত্রিম তন্তু, পোশাক খাতের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ওষুধ, প্লাস্টিক পণ্য, জুতা এবং চামড়াজাত পণ্য, বহুমুখী পাটপণ্যসহ পাটজাত পণ্য, কৃষিপণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য, হালকা প্রকৌশল পণ্য, জাহাজ এবং সমুদ্রগামী মাছ ধরার ট্রলার নির্মাণ, আসবাব, হোম টেক্সটাইল, লাগেজ ও ওষুধশিল্পের কাঁচামাল।
এদিকে বর্তমানে পোশাকশিল্পে যে বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্স-সুবিধা রয়েছে, তা রপ্তানিযোগ্য অন্য সব পণ্যের ক্ষেত্রেও দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। ফলে দেশ থেকে যেসব পণ্য রপ্তানি হবে, সেগুলো উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এবং যন্ত্রপাতি আমদানিতে উদ্যোক্তাদের কোনো শুল্ক পরিশোধ করতে হবে না। এই সুবিধার সঙ্গে শতভাগ রপ্তানিমুখী পণ্যের ক্ষেত্রে ডিউটি ড্র ব্যাক সুবিধাও থাকবে।
এসব উদ্যোগ রপ্তানি বহুমুখীকরণে কতটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র্যাপিডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, অনেক দেরি করার পর সামান্য নীতিসহায়তা দিয়ে পরিস্থিতির তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না। আবার এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আরও চ্যালেঞ্জ আসবে। বিশ্বের যেসব দেশ পণ্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে পেরেছে, তারা প্রত্যেকেই বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে করেছে। আমাদেরও সেই পথেই যেতে হবে। কারণ, বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসে। ফলে তারা পণ্য রপ্তানিতে ভালো দাম পায়।
পরিসংখ্যান কী বলছে
স্বাধীনতার পরের বছর মাত্র ৩৪ কোটি ৮৪ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ বা ৩১ কোটি ৩০ লাখ ডলারের পণ্যই ছিল পাট
এবং পাটজাত। পাটের পর প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল চা এবং হিমায়িত খাদ্য। যদিও মোট রপ্তানিতে এই দুটি পণ্যের অবদান ছিল মাত্র সোয়া শতাংশের কাছাকাছি।
স্বাধীনতার পর পণ্য রপ্তানির তালিকায় তৈরি পোশাকের কোনো নাম-নিশানা ছিল না। বেসরকারি খাতে ১৯৭৮ সালে প্রথম রিয়াজ গার্মেন্টসের মাধ্যমে পোশাক রপ্তানি শুরু হয়। এরপর একে একে অনেকে পোশাক কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগ করেন। সরকারও অনেক ধরনের নীতিসহায়তা নিয়েই এগিয়ে আসে। ফলে ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে মোট পণ্য রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের হিস্যা দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। পরের ৩০ বছরে সেটি ক্রমাগতভাবে বেড়ে ৮০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ১০ বছর ধরে মোট পণ্য রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের হিস্যা ৮১-৮৪ শতাংশের মধ্যেই রয়েছে।
এক যুগ আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে ২ হাজার ২৯৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে ৭৮ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক খাত থেকেই। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলার রপ্তানির মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশই তৈরি পোশাক খাত থেকেই এসেছে।






