
২০২১ সালের নভেম্বরে দীর্ঘদিন পর জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে থাকে সরকার। তখন আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের অন্যতম মানদণ্ড ব্রেন্ট ক্রুডের ব্যারেলপ্রতি দাম ছিল ৮৪ মার্কিন ডলার।
এর মাস তিনেক পর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরুপ অবস্থায় সরকার গত বছরের আগস্টে পণ্যটির দাম সাড়ে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে থাকে। তখন বৈশ্বিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিল ৯৪ ডলার।
দাম বাড়ানোর পর সরকার বারবারই বলেছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে দেশের বাজারে তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। তবে বিশ্ববাজারে ব্রেন্ট ক্রুডের ব্যারেলপ্রতি দাম ৭৩ ডলারে নেমে এলেও সরকারের পক্ষ থেকে তেলের দাম কমানোর কোনো প্রকার উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না।
অবশ্য বিশ্লেষকেরা বলছেন, গত জানুয়ারিতে দেশে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশের ওপরে ওঠে। মার্চে সেটি ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। গত মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। অবশ্য বিশ্ববাজারে গত এক বছরে শুধু জ্বালানি তেলই নয়, অনেক পণ্যেরই দামই কমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এমন প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে জ্বালানি তেলের দাম কমানো দরকার। তাঁদের মতে, ডলারের বিনিময় হার ধারাবাহিকভাবে বাড়ানো হলে পরিস্থিতি এতটা অসহনীয় হতো না।
গত মাসে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, অকটেন–পেট্রল–ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের দাম গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি লিটারে ৫ থেকে ১০ টাকা কমানোর সুযোগ রয়েছে। তারা বলেছে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কিনে দেশের বাজারে বিক্রি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) প্রতি লিটার ডিজেলে ৫ টাকা এবং অকটেনে ১৩ টাকা মুনাফা করে থাকে।
জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে অনেক কিছুর সম্পর্ক আছে। সে জন্য তেলের দাম বাড়লে পরিবহন ব্যয় ও শিল্প, কৃষি এবং বিদ্যুৎ—সবকিছুর উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়। কেবল বাংলাদেশই নয়, জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও বিপদে পড়েছিল। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে তো গত বছর মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠার রেকর্ড করে থাকে। কিন্তু তারা নীতি সুদহার বাড়িয়ে ধারাবাহিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, যা বাংলাদেশ পারছে না।
এদিকে দেশে সব সময়ই দেখা যায়, জ্বালানির দাম বাড়াতে বা কমাতে সরকার বেশ কিছুটা সময় নেয়। এর কারণ হলো দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেল সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি হয়ে থাকে।
এলএনজি ছাড়া অন্য কিছুতে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নেই বলে প্রতিযোগিতাও নেই। তেল আমদানি করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসি। ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে সরকার যে দাম ঠিক করে দেয়, সেই দামেই ভোক্তাদের তা কিনতে হয়ে থাকে । অর্থাৎ তেলের দাম নির্ধারিত হয় সরকারি সিদ্ধান্তে, বাজারের প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নয়।
তাছাড়া সরকার সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তেল কেনে। যখন চুক্তি হয়, তখন সে অনুযায়ী তেল পাওয়া যায়, তা সে বিশ্ববাজারে তেলের দাম যা–ই হোক না কেন। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হওয়ার কারণে পরবর্তী সময়ে দাম কমলেও চুক্তির দামই পরিশোধ করতে হয়ে থাকে।
বিশ্ব বাজারে মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ কম
তেলের দাম বাড়ানোর জন্য নানা চেষ্টা করছে রপ্তানিকারক দেশগুলোর জোট ওপেক এবং এর সহযোগী দেশগুলো। এই ক্ষেত্রে বিশেষ করে শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক সৌদি আরবের দৌড়ঝাঁপ লক্ষণীয়। ওপেক সম্প্রতি তেল উৎপাদন হ্রাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিশ্লেষকদের ভাষ্য অনুযায়ী, সৌদি আরবের বাজেট–ভারসাম্য বজায় রাখতে ও সিংহাসনের উত্তরাধিকারী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নে অপরিশোধিত তেলের দর প্রতি ব্যারেল ৮০ ডলারের ওপরে রাখতে চায় দেশটি।
অবশ্য গোল্ডম্যান স্যাকসের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এসব করে সৌদি আরব তেলের দাম বড়জোর ১ থেকে ৬ ডলার বাড়াতে পারে। কিন্তু তাতে ভোক্তাদের তেমন কিছু আসবে যাবে না অথবা যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসোলিনের দাম সে কারণে রাজনৈতিকভাবে হুমকিতে পড়বে না। কারণ, সেই দেশের পাম্পগুলোতে এখন তেলের দাম গত বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ কম।
এদিকে রাশিয়ার ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটি যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি চাঙা রাখতে বিশ্ববাজারে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল ছাড়ছে। ফলে বাজারে তেলের অভাব হচ্ছে না। সেই সাথে বৈশ্বিক অর্থনীতির মন্থরতায়, বিশেষ করে চীনের শ্লথগতির কারণে তেলের তেমন দাম বাড়ছে না।
এদিকে বাংলাদেশের মন্ত্রীরা বারবার একটি কথা বলে আসছেন যে তেলের বাজার খুব অস্থিতিশীল, দাম কমলে আবার বাড়তেও তেমন সময় লাগে না। কথাটির মধ্যে সত্যতার উপাদান আছে বটে। আবার এটাও সত্য, দীর্ঘ মেয়াদে তেলের মূল্য খুব একটা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা কম। বিশ্ববাজারের গতিপ্রকৃতির কারণেই তেলের দাম খুব একটা বাড়বে না।
জ্বালানি বাবদ ভর্তুকি
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) দেশের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিবছরই অপরিশোধিত এবং পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত এবং পরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য ওঠানামা করে থাকে। সরকারের একটি বার্ষিক প্রতিবেদন বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা–২০২৩ অনুসারে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে কম মূল্যে দেশের বাজারে জ্বালানি তেল বিক্রির কারণে বিপিসি ক্রমাগত লোকসানের সম্মুখীন হয়েছে। ফলে জ্বালানি তেল বাবদ সরকারকে একসময় বিপুল ভর্তুকি দিতে হয়ে থাকে।
তবে ২০১৪ সালের নভেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য হ্রাস পাওয়ায় ২০১৫–১৬ অর্থবছর থেকে ২০২০–২১ অর্থবছর পর্যন্ত সরকারকে জ্বালানি তেলে কোনো ভর্তুকি দিতে হয়নি। বদৌলতে ২০১৪-১৫ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত টানা সাত বছরে বিপিসি মুনাফা করেছে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। কর দেওয়ার পর সংস্থাটির নিট মুনাফা দারিয়েছে ৩৬ হাজার ৭৪ কোটি টাকা। এই সময়ে ৭ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা কর দিয়েছে বিপিসি।
তবে ২০২১–২২ অর্থবছরের দ্বিতীয় ভাগে ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পায়। তাতে বিপিসির ২ হাজার ৭০৫ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা লোকসান হয়। বিপিসি চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি) ৭ হাজার ৮৭ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে বলে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে।
বিশ্ব বাজারের সাথে দাম সমন্বয়
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদনের বিপরীতে যেসব শর্ত দেয়, সেই অনুযায়ী আগামী সেপ্টেম্বর থেকে জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রে নতুন ফর্মুলাভিত্তিক মূল্য সমন্বয়প্রক্রিয়া কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। নতুন এই ফর্মুলা অনুযায়ী শুরুতে তিন মাস পরপর জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের চিন্তা করছে সরকার, তবে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত নয়। প্রতিবেশী ভারতে প্রতিদিন জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হয়ে থাকে।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, দেশে মূল্যস্ফীতির হার এখন ৯ শতাংশের ওপরে। এ বাস্তবতায় তেলের দাম কমানো হলে অর্থনীতির সব খাতই লাভবান হবে। এই ছাড়া তেলের দাম কমানো হলেও কতটা কমানো হবে, সেটিও একটি প্রশ্ন থেকে যায়। প্রস্তাবিত বাজেটে তেল আমদানিতে সুনির্দিষ্ট শুল্ক আরোপের কথা বলা হয়েছে, তাতে তেলের দাম যা–ই হোক না কেন, সরকার একটি নির্দিষ্ট হারে শুল্ক নেবে। অর্থাৎ তেলের দাম যা–ই হোক না কেন, সরকার তেল থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক আদায় করবে। এমন পরিস্থিতিতে তেলের দাম তেমন একটা কমবে না।
সেলিম রায়হান আরও বলেন, ‘এককভাবে শুধু বিপিসির মাধ্যমে আমদানি না করে অন্যান্য সংস্থাকে দিয়েও আমদানি করানো যায়। এতে বাজারে কিছুটা প্রতিযোগিতা আসত। অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান যদি ভিন্ন উৎস থেকে কম দামে তেল আমদানি করতে পারে, তাহলে তো আর সমস্যা নেই, তাতে ভোক্তাদেরই লাভ হবে ।’
প্রকাশক: মনসুর মো. এন হাসান
সম্পাদক: মো. আশরাফুল ইসলাম
প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী-সম্পাদক: আনোয়ার সজীব