২০২২ সালে নানা কারণে বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমেছে। তবে বিশ্বব্যাংক এবং নোমাডের মাইগ্রেশন ডেভেলপমেন্ট ব্রিফে বলা হয়েছে, চলতি ২০২৩ সালে দেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ৬ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। সেই হিসাবে এই বছর দেশে প্রবাসী আয় আসতে পারে  প্রায় ২৩ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২৪ সালে প্রবাসী আয়ের প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩ শতাংশ।

নোমাড হলো অভিবাসন এবং উন্নয়নবিষয়ক একটি বৈশ্বিক জ্ঞানকেন্দ্র। ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক সদর দপ্তরে এই প্রতিষ্ঠানের সচিবালয় অবস্থিত।

চলতি বছর বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক বলছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাথে ৪৭০ ডলারের ঋণচুক্তির কারণে দেশের অর্থনীতি সম্পর্কে প্রবাসীদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। যদিও বিশ্বব্যাংক বলছে, গালফ কো-অপারেশন জোটভুক্ত যেসব দেশে প্রবাসীরা থাকেন, সেখানকার অবস্থা প্রতিকূল।

বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ৩ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। গত বছর দেশে প্রবাসী আয় এসেছিল ২১ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ২ হাজার ১৫০ কোটি ডলার।

২০২২ সালে সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়লেও বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং নেপালের প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমে গেছে। বিশ্বব্যাংক মনে করছে, এসব দেশের টালমাটাল অর্থনীতির প্রভাব প্রবাসী আয়ের প্রবাহে পড়েছে। সেই সাথে এসব দেশের মুদ্রার দরপতনও হয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, এসব দেশের রপ্তানিপণ্যের চাহিদা কমে যাওয়া, বর্ধিত সুদহারের কারণে ঋণ পরিশোধের ব্যয় বৃদ্ধি, জ্বালানি এবং খাদ্যের উচ্চ মূল্যের কারণে ব্যালান্স অব পেমেন্টে চাপ—এসব কারণে স্থানীয় মুদ্রার দরপতন হয়েছে।

আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় কমে যাওয়ার পেছনে মুদ্রার একাধিক দরের বিষয়টি উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। তারা বলছে, বাংলাদেশে ডলারের আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক হারের ব্যবধান ১২ থেকে ১৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এই ব্যবধান এবং দীর্ঘস্থায়ী অনিশ্চয়তার কারণে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রবাসীরা দেশে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের চেয়ে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন।

বিশ্বব্যাংকের হিসাব, ডলারের আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক বিনিময় হারের মধ্যে ১ শতাংশ ব্যবধানের কারণে আনুষ্ঠানিক খাত থেকে প্রায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবাসী আয় অনানুষ্ঠানিক খাতে চলে যায়। সেখানে বাংলাদেশে এই ব্যবধান ১৮ শতাংশ পর্যন্ত উঠে এসেছে। ফলে কী পরিমাণ প্রবাসী আয় আনুষ্ঠানিক খাত থেকে অনানুষ্ঠানিক খাতে প্রবাহিত হচ্ছে, এই হিসাব থেকে তা ধারণা করা করা যায়।

বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ কমলেও ২০২২ সালে সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বেড়েছে ১২ শতাংশ। গত বছর মোট ১৭৬ বিলিয়ন বা ১৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে। এই প্রবৃদ্ধির কারণ হিসেবে বিশ্বব্যাংক যা বলছে তা এরূপ—উচ্চ আয়ের দেশগুলোর শক্তিশালী শ্রমবাজার, গালফ কো-অপারেশনভুক্ত (জিসিসি) দেশগুলোতে স্বল্প দক্ষ শ্রমিকদের উচ্চ চাহিদা এবং জিসিসিভুক্ত দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় কঠোর পদক্ষেপের কারণে শ্রমিকদের প্রকৃত আয় বৃদ্ধি।

২০২২ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে ভারতে, স্বাভাবিকভাবে দক্ষিণ এশিয়াতেও তারা রয়েছে শীর্ষে। গত বছর তারা প্রবাসী আয় পেয়েছে ১১১ বিলিয়ন বা ১১ হাজার ১০০ কোটি ডলার। এই ক্ষেত্রে দেশটির প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে ২৪ শতাংশ। বৈশ্বিক তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান আছে পঞ্চম স্থানে, আরভবাংলাদেশ রয়েছে সপ্তম অবস্থানে।

বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের নিরিখে প্রবাসী আয়ের ভূমিকা অনেক কম, ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মধ্যে নেপালের জিডিপি-প্রবাসী আয়ের অনুপাত সর্বোচ্চ—২৩ দশমিক ১ শতাংশ। এই ছাড়া পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা ৭ দশমিক ৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কার ৫ দশমিক ১ শতাংশ, ভুটানের ৩ দশমিক ৬ শতাংশ, ভারতের ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, আফগানিস্তানের ২ দশমিক ১ শতাংশ এবং মালদ্বীপের শূন্য দশমিক ১ শতাংশ।

বিশ্বব্যাংক এবং নোমাডের যৌথ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড–পরবর্তী পৃথিবীতে বাহ্যিক অর্থায়নের উৎস হিসেবে প্রবাসী আয়ের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গত বছরের চিত্রকে ইতিবাচক হিসেবে বর্ণনা করে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বিশ্বের নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বেড়েছে প্রায় ৮ শতাংশ, এমনকি তা বিশ্বব্যাংক ও নোমাডের পূর্বাভাসও ছাড়িয়ে গেছে। ২০২১ সালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, সেই হিসাবে ২০২২ সালের প্রবৃদ্ধির হার উল্লেখযোগ্য মনে করছেন তারা।

নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রবাসী আয় পাঠানোর খরচ এখনো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) নির্ধারিত হারের চেয়ে বেশি। উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবাসী আয় পাঠানোর ব্যয় সবচেয়ে কম, যদিও তা এসডিজির হারের চেয়ে বেশি।