সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক মুহাম্মাদ গালীব খান এবং তাঁর স্ত্রী বড় অঙ্কের অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। এখন তাঁরা দুদকের জালে।

গালীব খান এবং তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদক অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের দায়ে আলাদা দুটি মামলা করেছে।

সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উপকমিটিতে গালীবের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল।

স্বামী এবং স্ত্রী মিলে জমি কিনেছেন, ফ্ল্যাট কিনেছেন, গাড়ি কিনেছেন। বিনিয়োগ করেছেন শেয়ারবাজারেও। বড় অঙ্কের টাকা রেখেছেন ব্যাংকেও। কিন্তু এসব টাকা তাঁদের আয়ের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। এই দম্পতি রয়েছে এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এর জালে।

স্বামীর নাম মুহাম্মাদ গালীব খান, যিনি সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক। তাঁর স্ত্রীর নাম তানিয়া সুলতানা ওরফে রাখি। তিনি বেসরকারি একটি ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট।

গালীব খান এবং তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদক গত ১২ অক্টোবর অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের দায়ে আলাদা দুইটি মামলা করেছে। মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে মোট ৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে।

দুদক মামলা করেছে প্রাথমিক অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদের তথ্য পেয়ে। এখন চলছে মামলার তদন্ত। সমবায় অধিদপ্তর সূত্রের অভিযোগ, গালীব খান সমবায় সমিতিতে অনিয়মের সুযোগ দিয়ে ও নিয়োগ-বাণিজ্য করে অবৈধ আয় করেছেন। সেই আয় দিয়েই সম্পদ অর্জন করেছেন।

অধিদপ্তরে এখন একটি নিয়োগপ্রক্রিয়ার কাজ  চলছে। সেখানেও কোনো কোনো অসাধু কর্মকর্তা প্রার্থীদের কাছ থেকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে বড় অঙ্কের অর্থ নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

গালীব খান তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অধীনস্থ এক কর্মচারীর দুর্নীতিতে বাধা দেওয়ায় ওই কর্মচারী দুদকে কর্মরত তাঁর এক আত্মীয়কে দিয়ে মামলা করিয়েছেন। তিনি বলেন, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মিলে মাসে পাঁচ লাখ টাকা বেতন পান। তিনি শেয়ার ব্যবসাও করেন। সেই টাকা দিয়ে ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে তাঁরা সম্পদ গড়েছেন।

অবশ্য দুদকের দুইটি মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, কয়েকটি ক্ষেত্রে বৈধ আয় এবং সেই আয় দিয়ে সম্পদ অর্জনের প্রমাণ গালীব খান এবং তাঁর স্ত্রী দেখাতে পারেননি। তাঁদের আয় এবং সম্পদের মূল্য পর্যালোচনা করেই জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের হিসাব পাওয়া গেছে।

গালীবের মোট কত সম্পদ

সমবায় অধিদপ্তর সূত্র জানায় যে, ২০০৮ সালের ২৩ নভেম্বর গালীব খান বিসিএস সমবায় ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে সমবায় অধিদপ্তরে সহকারী নিবন্ধক হিসেবে যোগ দিয়ে থাকেন। ২০১৬ সালে তিনি জেলা সমবায় কর্মকর্তা হন। ২০১৮ সালে উপনিবন্ধক হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে থাকেন।

অভিযোগ রয়েছে, গালীব খান জেলা সমবায় কর্মকর্তা থাকাকালে ২০১৭ সালে ডেসটিনি এবং মমতা সমবায় সমিতির দুই শীর্ষ নেতার যোগসাজশে ওই সমবায় সমিতি দুটি থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা তিনি আত্মসাৎ করেন। দুদকের মামলার এজাহার বলছে, গালীব খান রাজধানীর খিলগাঁওয়ের জমি কিনে সেখানে ১ হাজার ৪১৬ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট (যৌথভাবে) মালিক হয়েছিলেন। তিনি ফরিদপুরে ৬২ শতাংশ জমি কিনেছেন। তাঁর ব্যাংকে জমা টাকা এবং সঞ্চয়পত্র রয়েছে।

গালীব খানের যে স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পদ পাওয়া গেছে, তার দাম প্রায় ২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। বিপরীতে তিনি বেতন-ভাতা বাবদ ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত আয় দেখিয়েছেন প্রায় ৬২ লাখ টাকা, যা মাসে গড়ে দাঁড়ায় ৪০ হাজার টাকা। তিনি চাকরির ভবিষ্য তহবিলের (প্রভিডেন্ট ফান্ড) সুদ বাবদ ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা, ব্যাংকে স্থায়ী আমানতের সুদ বাবদ ৭৬ হাজার, জমি বিক্রি থেকে ৯ লাখ ৮৭ হাজার ও শেয়ারবাজারের বিনিয়োগের বিপরীতে লভ্যাংশ বাবদ প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ টাকার আয় দেখিয়েছেন।

দুদক বলছে, গালীব খান জমি বিক্রি থেকে আয়ের বিপরীতে দালিলিক কোন প্রমাণ দেখাতে পারেননি। ভবিষ্য তহবিলের সুদ তাঁর সম্পদ, যা তহবিলের মূল টাকার সাথে যোগ হয়। এটা আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচিত নয়। শেয়ারবাজার থেকে তিনি যে আয় দেখিয়েছেন, তার আগেই সম্পদ অর্জন করেছেন। সব মিলিয়ে তাঁর ২ কোটি ১৪ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের বৈধতার উৎস নেই। গত বছরের অক্টোবরে বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগে গালীব খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকে দুদক।

স্ত্রীর নামে সম্পদ বেশি

গালীব খানের স্ত্রী তানিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলায় বলা হয়, তিনি রাজধানীতে সাড়ে তিন কাঠা করে দুটি প্লটের মালিক। ধানমন্ডিতে তাঁর একটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ফরিদপুরে তিনি আড়াই একরের বেশি জমি কিনেছেন। ব্যাংকে টাকা, সঞ্চয়পত্র এবং গাড়ি রয়েছে তাঁর। সব মিলিয়ে তানিয়া সুলতানার সম্পদের মূল্য প্রায় ৭ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা। তিনিও ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকার সম্পদ অর্জনের সপক্ষে কোন প্রমাণ দেখাতে পারেননি।

গালীব খান এবং তানিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে মামলা দুটি করেছিলেন দুদকের তৎকালীন উপপরিচালক শাহীন আরা মমতাজ। সম্প্রতি তিনি অবসরে গেছেন। তিনি বলেন, অনুসন্ধান শেষে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে।

গালীব খান এবং তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের করা মামলার বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মোছা. ফাহমিদা আকতার প্রথম আলোকে বলেন, মামলা দুটির তদন্ত চলছে। মামলায় উল্লেখ করা তথ্যের বাইরে এই দম্পতির আরও অবৈধ সম্পদ আছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সংসদীয় কমিটি ব্যবস্থা নিতে বলেছিল

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন এবং সমবায় মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উপ-কমিটিতে ২০১৮ সালে গালীব খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। এতে বলা হয়, গালীব খানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সমবায় অধিদপ্তরকে সুপারিশ করা হয়েছিল। দুদকও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করে থাকে। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে কর্তৃপক্ষ তাঁকে জেলা সমবায় কর্মকর্তা থেকে পদোন্নতি দিয়ে উপনিবন্ধক করেছে।

সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তরুণ কান্তি সিকদার বলেন, গালীব খানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। সেখান থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ায় পর তিনি পদোন্নতি পান। তিনি বলেছেন, তদন্ত শেষে দুদক গালীব খানের মামলায় অভিযোগপত্র দিলে তাঁর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।