এ যেন তান্ডব রুপে মিরাজ। আরো যদি পায় মাহমুদুল্লাহর সঙ্গ। ‘অবিশ্বাস্য’, ‘বিস্ময়কর’—এসব কি আর আজ লেখা যায়? এসব তো আগের ম্যাচেই লেখা হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সিরিজ জয়ে আরেকটি রোমাঞ্চকর কীর্তির মহিমা প্রকাশে কোন বিশেষণের অলংকার পরানো যায় তাঁকে? মেহেদী হাসান মিরাজের কোন কীর্তিটা আসলে বড়?
মধুর এক সমস্যাই বটে। প্রতিদিন ভালো খেলবেন, ম্যাচ জেতাবেন, আর প্রতিদিনই মিরাজকে বিশেষণের অলংকারে সাজিয়ে উপস্থাপন করতে হবে। কিন্তু বিশেষণেরও তো একটা ‘স্টক’ আছে। মিরাজ যে সে ‘স্টক’ ফুরিয়ে দিচ্ছেন!

জানি এই লাইনটা পড়ার পর কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে উঠবেন এই বলে যে, অতি বাড় বেড়ো না ঝড়ে ভেঙে যাবে। দুইটা ম্যাচ ভালো খেলেছে বলেই কাউকে এমন আকাশে তুলে দেওয়া কেন ভাই! এরপর যখন আবার খারাপ খেলতে শুরু করবেন, তখন কী করবেন?
তখন সমালোচনা হবে। লেখা হবে মিরাজ এই ভুলটা করেছেন, ওই ভুলটা তাঁর করা ঠিক হয়নি।
কিন্তু যখন তিনি সাফল্যের পঙ্খীরাজে চড়ে ব্যাটটাকে অগ্নীশিখা, বলটাকে ঘূর্ণি গোলক বানিয়ে প্রতিপক্ষকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে বাংলাদেশের জয়ের পতাকা ওড়াচ্ছেন, তখন তো বিশেষণের মালাই তাঁর প্রাপ্য। সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ‘খারাপ সময়ে’র কথা ভেবে আজই কেন তাঁর সাফল্যের গল্পে হাতকড়া পরানো! সেদিনের মতো আজও বরং উদ্যাপনের আরেক নাম হোক ‘মিরাজ’।
ক্রিকেটে একটা কথা চির সত্যি। আজ যার ব্যাটে রান নেই, আজ যার হাতে উইকেট নেই; কাল তিনিই এমন কিছু করে দিতে পারেন, যেটাতে তাঁর ব্যর্থতার কথা সবাই ভুলে যাবে। সমালোচকেরা লজ্জাবনত হবেন। আবার উল্টোটাও হয়। দুই ম্যাচের ব্যর্থতাই সাফল্যকে ঢেকে দিয়ে নেতিবাচক আলোচনায় ‘খলনায়ক’ বানিয়ে দিতে পারে যে কাউকে।
ক্রিকেটাররা এটা জেনেই ক্রিকেট খেলেন। যাঁরা সেই বিরুদ্ধ স্রোত পার হয়ে সাফল্যের তিরে পৌঁছাতে পারেন, তারাই সত্যিকারের বীর, বড় ক্রিকেটার।
চোখে লেগে থাকার মতো সেঞ্চুরিতে মিরাজ যাঁকে আজ ভারতের বিপক্ষে জয়ের পার্শ্বনায়ক বানিয়ে দিলেন, সেই মাহমুদউল্লাহর কথাই ধরুন। টি-টোয়েন্টির ব্যর্থতা তাঁকে সম্প্রতি এতটাই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছিল যে অনেকে ভুলেই গিয়েছিলেন তাঁর ওয়ানডের ফর্ম নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। ভুলে গিয়েছিলেন এই মাহমুদউল্লাহই এক সিরিজ আগে ওয়ানডেতে ৮৪ বলে অপরাজিত ৮০ রানের ইনিংস খেলেছেন।
এসব মাহমুদউল্লাহর ওপর একটা চাপ তৈরি করেছিল নিশ্চিত। পরিসংখ্যান দেখে আপনি না হয় ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণের পারফরম্যান্সকে আলাদা করতে পারেন। কিন্তু সমালোচনাজনিত যে চাপ সেটাকে একজন ক্রিকেটার আলাদা করবেন কীভাবে?

মাহমুদউল্লাহর দুর্ভাগ্য, ভারতের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে ৩৫ বলে ১৪ রান করে আউট হয়ে গেছেন। দল যখন তাঁর ব্যাটে নির্ভরতা খুঁজছিল, তিনি পারেননি আস্থার প্রতিদান দিতে। পরিণতি অনুমিতই ছিল। টি-টোয়েন্টির ব্যর্থতার সমালোচনার ধাক্কা লাগল ওয়ানডের মাহমুদউল্লাহর গায়েও। ভাগ্য ভালো মিরাজ-মোস্তাফিজ মিলে সে ম্যাচে নাটকীয় জয় এনে দিয়েছেন। নইলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সর্বত্র সেদিন মিরাজ-বন্দনার চেয়ে মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে নিন্দার ঝড়ই হয়তো বেশি উঠত।
সেই মাহমুদউল্লাহ আজ কি করেছেন দেখুন। মিরাজ তো পরে এলেন, তার আগে প্রথম ধাক্কাটা তিনিই সামলেছেন। দলের ৬৬ রানে চতুর্থ ব্যাটসম্যান হিসেবে সাকিব আল হাসান ফিরে যাওয়ার পর উইকেটে এসে প্রথমে মুশফিক ও পরে আফিফকে ফিরে যেতে দেখেছেন। এরপর মিরাজের সঙ্গে মাহমুদউল্লাহর ১৪৮ রানের জুটি, যেটি শুধু বাংলাদেশকে এক ম্যাচ বাকি থাকতে সিরিজই জিতিয়ে দেয়নি, ওয়ানডেতে বাংলাদেশের হয়ে সপ্তম উইকেট জুটিতে এটিই এখন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জুটি।
ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নিতে ইনিংসের শেষ ওভারে ১৫ রান করতে হতো মিরাজকে। শার্দুল ঠাকুরের বলে ফাইন লেগ আর ডিপ মিড উইকেট দিয়ে দুই ছক্কার পর শেষ দুই বলে ২ আর ১ রান নিয়ে মিরাজ ভেসেছেন সেই উদ্যাপনে। শূন্যে ঘুষি ছুড়েছেন, হেলমেট আর ব্যাট তুলে তাকালেন ড্রেসিংরুমে থাকা সতীর্থদের দিকে।
উমরান মালিকের বলে উইকেটকিপার লোকেশ রাহুল শূন্যে ভেসে দুর্দান্ত ক্যাচটা না নিলে একই রকম উদ্যাপন করতে পারতেন মাহমুদউল্লাহও। টালমাটাল অবস্থায় উইকেটে এসে যেভাবে ধীরে ধীরে ইনিংসের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়েছেন, ‘অবিশ্বাস্য’ বিশেষণটা আজ তাঁর ইনিংসেরও প্রাপ্য। মাহমুদউল্লাহর ৯৬ বলে ৭৭ রানের ইনিংসটি মনে করিয়ে দিচ্ছিল ২০১৫ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাঁর সেই দুই সেঞ্চুরির কথাও।







